২০১৭ সালের পাঠ্যপুস্তক সাম্প্রদায়িক বিষয় প্রত্যাহারে উদ্যোগ নেই

রাকিব উদ্দিন :  ২০১৭ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই থেকে সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় চেতনার বিষয়বস্তু প্রত্যাহারের উদ্যোগ না নিয়ে ভুল ও তথ্য বিভ্রাট সুরাহার জন্য দৌড়ঝাঁপ করছে এনসিটিবি।

নতুন শিক্ষাবর্ষে সাম্প্রদায়িক এবং ভুলেভরা পাঠ্যপুস্তক নিয়ে চরম বেকায়দায় পড়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এই প্রেক্ষাপটে পাঠ্যপুস্তকের ভুলত্রুটি-চিহ্নিত করা সংক্রান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি এক সপ্তাহ বিলম্বে গতকাল তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেছে। কিন্তু পাঠ্যক্রম থেকে সাম্প্রদায়িক চেতনার বিষয়বস্তু প্রত্যাহারের ব্যাপারে কোন কমিটি গঠন করা হয়নি।

এদিকে ২০১৬ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবইয়েও বেশকিছু ভুলত্রুটির প্রমাণ পেয়েছিল এ সংক্রান্ত বিষয়ে গঠিত এনসিটিবির একটি তদন্ত কমিটি। কিন্তু ওই কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী ভুলত্রুটি ও ইতিহাস বিকৃতির জন্য দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

জানা গেছে, দুই মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নানা কৌশলে পাঠ্যক্রমের সাম্প্রদায়িক বিষয় ও লেখার সমালোচনা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন, কিন্তু ভুল ও তথ্য বিভ্রাটের জন্য একে অন্যের ঘাড়ে দায় চাপাচ্ছেন। পাঠ্যক্রমে একটি বিশেষ ধর্মের চেতনার প্রতিফলন ঘটনায় দেশব্যাপী সমালোচনার মুখে দুই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা এখন ‘এনসিটিবি’কে (জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড) বিভক্ত করার মনস্তাত্তি্বক লড়াইয়ে লিপ্ত হয়েছেন।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এনসিটিবিতে তাদের একটি উইং (অনুবিভাগ) থাকলেও সেখানে তাদের নিজস্ব লোকবল নিয়োগের সুযোগ দিচ্ছে না শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আর এনসিটিবির কর্মকর্তা বলছেন, এনসিটিবি পুরোপুরিই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন। এর সাফল্য-ব্যর্থতার যাবতীয় দায়ভারও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, ‘এনসিটিবিতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোন পদ ও উইং নেই। এটি পুরোপুরি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে। এখানে গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা পদায়নের সুযোগ নেই। তাদের কোন এখতিয়ারও নেই।’

এ ব্যাপারে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব গিয়াস উদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের জানান, এনসিটিবি দুই মন্ত্রণালয়ের বই ছাপে। কিন্তু পুরো কর্তৃত্ব খাটায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এটা হতে পারে না। এজন্য এনসিটিবিতে নিজেদের ২২ জন কর্মকর্তা নিয়োগের জন্য গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৫ সালের ১৯ জুন সরকারের সচিব কমিটির (৩.৪.১) সিন্ধান্ত অনুযায়ী সংস্থাপন (বর্তমানে জনপ্রশাসন) মন্ত্রণালয় এবং অর্থ বিভাগের সম্মতির ভিত্তিতে প্রকল্পভুক্ত ২৫টি পদ এবং এনসিটিবির স্থায়ী ৯টি পদসহ মোট ৩৪টি পদ সমন্বয়ে এনসিটিবিতে প্রাথমিক শিক্ষাক্রম উইং সৃজনের সুপারিশ করা হয়।

সচিব কমিটির সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতায় ২০০৫ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর এডিবি সাহায্যপুষ্ট চট্টগ্রাম, সিলেট ও বরিশাল বিভাগের প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্পের এনসিটিবি ইউনিটের অস্থায়ী ২৫টি পদ এবং এনসিটিবির স্থায়ী ৯টি পদসহ মোট ৩৪টি পদ সমন্বয়ে রাজস্ব খাতে এনসিটিবির প্রাথমিক শিক্ষাক্রম উইং সৃজনের আদেশ জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওই আদেশ অনুযায়ী প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ২৫টি পদ স্থায়ীভাবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ন্যস্ত করে।

তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপে প্রাথমিকের বই মুদ্রণ বিলম্ব

মুদ্রণ ও বাঁধাইয়ের মান এবং আর্থিক সাশ্রয়ের কারণে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণে আন্তর্জাতিক দরপত্র সরকারের কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্যতা পেলেও প্রাথমিক স্তরের বইয়ের ওপর তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপের কারণে নানা জটিলতা ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে।

কারণ প্রাথমিক শিক্ষা স্তরের পাঠ্যবই ছাপা হয় আন্তর্জাতিক দরপত্রে, যার অর্থায়ন করে গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই অর্থায়নের ১০/১৫ শতাংশ ঋণ হিসেবে দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক। এজন্য প্রতিবার আন্তর্জাতিক অর্থলগি্নকারী সংস্থাটি বইয়ের মান নিয়ন্ত্রণের নামে কিছু শর্তারোপ করে। এসব শর্ত অনুসরণ করতে গিয়ে প্রতিবারই পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণে বিলম্ব হয়, যাতে শিক্ষাবর্ষের শেষদিকে এসে যথাসময়ে সব বই মুদ্রণ ও সরবরাহে গলদঘর্ম পরিস্থিতিতে পড়ে এনসিটিবি।

২০১৭ শিক্ষাবর্ষের বিনামূল্যের প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের দরপত্র সংক্রান্ত তথ্যাবলি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সিডিউল প্রণয়ন, সিডিউল এনসিটিবি কর্তৃক অনুমোদন, সিডিউল বিশ্বব্যাংক কর্তৃক অনুমোদন, পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, উন্মুক্তকরণ, মূল্যায়ন, মূল্যায়ন প্রতিবেদন এনসিটিবি ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কর্তৃক অনুমোদন, মূল্যায়ন প্রতিবেদন ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা ও বিশ্বব্যাংক কর্তৃক অনুমোদন, বিডারদের (ঠিকাদার) নোটিফিকেশন অব এওয়ার্ড (এনওসি) প্রদানের তারিখ, চুক্তিপত্র সম্পাদনের তারিখ এবং এলসি সম্পন্ন করাসহ সকল প্রক্রিয়ায় প্রাথমিক স্তরের বই মুদ্রণের কার্যক্রম বিলম্ব হয়।

২০১৭ শিক্ষাবর্ষের বই ছাপাতে মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবই মুদ্রণের দরপত্র আহ্বান করা হয় গত বছরের ১৬ মার্চ এবং প্রাথমিকের দরপত্র আহ্বান হয় ১৭ এপ্রিল, মাধ্যমিকের দরপত্র মূল্যায়ন হয় ৯ মে এবং প্রাথমিকের দরপত্র মূল্যায়ন হয় ১৫ জুলাই, মাধ্যমিকের দরপত্রের মূল্যায়ন প্রতিবেদন ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভার অনুমোদন পায় ২২ জুন এবং প্রাথমিকের মূল্যায়ন প্রতিবেদন অনুমোদন পায় এক মাস সাত দিন বিলম্বে ২৫ আগস্ট, মাধ্যমিকের বই ছাপতে ঠিকাদারদের এনওসি দেয়া হয় ২৩ জুন এবং প্রাথমিকের ক্ষেত্রে তা হয় ২৮ আগস্ট, ঠিকাদারদের সাথে মাধ্যমিকের বই ছাপার চুক্তি হয় ২৮ জুলাই এবং প্রাথমিকের চুক্তি হয় ২৪ সেপ্টেম্বর। আর প্রাথমিকের বইয়ের জন্য বিদেশি প্রতিষ্ঠানের এলসি সম্পন্ন হয় ১৬ নভেম্বর, যা মাধ্যমিকের বইয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

এনসিটিবিতে তদন্ত কমিটি

শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০১৭ সালের পাঠ্যপুস্তকে ভুলত্রুটি নির্ণয় ও ভুলত্রুটির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে যথাযথ সুপারিশ প্রদানের লক্ষ্যে অতিরিক্ত সচিব রুহী রহমানকে আহ্বায়ক করে গত ৯ জানুয়ারি তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের যুগ্মসচিব মাহমুদুল ইসলাম এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের পরিচালক (মাধ্যমিক)।

এ কমিটিকে ৭ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয়া হলেও ৭ কর্মদিবস শেষে গতকাল তারা কেবল কার্যক্রম শুরু করেছে। এজন্য কমিটির আন্তরিকতা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্টরা। তদন্ত কমিটির সদস্যরা গতকাল এনসিটিবিতে গিয়ে সংস্থার কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলেন।

২০১৬ সালের ভুলত্রুটির জন্য দায়ীদের শাস্তি হয়নি

২০১৬ সালের পাঠ্যবইয়ে বানান ভুল, তথ্য বিভ্রাট, ইতিহাস বিকৃতি এবং কবিতা বিকৃতির ঘটনা তদন্তে সংস্থার ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞ মেহের নিগারের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল এনসিটিবি। কিন্তু এসব ঘটনার জন্য তদন্ত প্রতিবেদনে যাদের দায়ী করা হয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি এবং বেশিরভাগ সুপারিশও বাস্তবায়ন করা হয়নি।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ‘পঞ্চম শ্রেণীর বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় পাঠ্যপুস্তকে বাহাদুর শাহ পার্কের নির্মাণকাল ও শতাব্দী, নেপালে ভূমিকম্পের তারিখ এবং জাতিসংঘের প্রশাসনিক শাখা সম্পর্কিত ভুল তথ্য সনি্নবেশের জন্য বইয়ের লেখক, সম্পাদক, বিষয় বিশেষজ্ঞ ও পরিমার্জনকারীরা কোনভাবেই দায় এড়াতে পারেন না।’

সপ্তম শ্রেণীর সপ্তবর্ণা পাঠ্যপুস্তকে সংকলিত সুকুমার রায়ের ‘আনন্দ’ কবিতার পদবিন্যাসে অসঙ্গতির জন্য উক্ত পাঠ্যপুস্তকের লেখক ও সম্পাদক পরিষদ দায়ী। ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত এই পুস্তকটির বিশেষজ্ঞের দায়িত্ব পালন করা এনসিটিবির বিশেষজ্ঞ হান্নান মিয়া এবং গবেষণা কর্মকর্তা সৈয়দ মইনুল হাসান কবিতাটির ত্রুটি চিহ্নিত ও সংশোধন করতে ব্যর্থ হয়েছিন বিধায় এ ত্রুটির জন্য উক্ত কর্মকর্তারা দায়ী।’

মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস সম্পর্কিত ভুল তথ্য পাঠ্যপুস্তকে সনি্নবেশ করার জন্য সৈয়দ মইনুল হাসান কর্তব্য কাজে অবহেলাসহ চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন বলে প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়।

এছাড়াও ‘পাঠ্যপুস্তকে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ শব্দটি থেকে ‘ষড়যন্ত্র’ শব্দটি প্রত্যাহার করে নেয়ার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ডেপুটি স্পিকার শওকত আলীর নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট বিষয় বিশেষজ্ঞ এ নির্দেশনা পালনে দায়িত্বহীনতা ও কর্তব্য কাজে অবহেলার পরিচয় দিয়েছেন বলেও ২০১৬ সালের তদন্ত কমিটি মন্তব্য করে।

গত বছরের তদন্ত প্রতিবেদনের ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, ‘গত বছর আমি চেয়ারম্যান ছিলাম না। এখন আমি এ ব্যাপারে খোঁজখবর নেব। তবে আমি যতটুকু জানি, কোন তদন্ত প্রতিবেদন করা হলে তা মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়। মন্ত্রণালয়ই কেবল তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে ব্যবস্থা নিতে পারে।’ সংবাদ।

Facebooktwitterredditpinterestlinkedinby feather
Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।