সময়মতো স্মার্টকার্ড পাচ্ছে না নাগরিকরা

জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে জালিয়াতির ঘট333-300x184না রোধে এবং নাগরিকদের তথ্য আরও সুরক্ষিত রাখতে জাতীয় পরিচয়পত্রের বদলে স্মার্টকার্ড দেওয়ার প্রকল্প হাতে নেয় নির্বাচন কমিশন। ১৬ ডিসেম্বর থেকেই নাগরিকদের হাতে পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল এই কার্ড। কিন্তু তথ্য প্রযুক্তিসমৃদ্ধ এই কার্ড করার কাজ সময়মতো শেষ হচ্ছে না। আগামী বছরের মার্চে স্মার্টকার্ড বিতরণ করা হতে পারে। বিস্তারিত জানাচ্ছেন বিলকিছ ইরানী

সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রতিটি নাগরিককে জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার প্রকল্প নেওয়া হয়। কিন্তু নকল করা সহজ বলে জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে জালিয়াতির ঘটনা ঘটছে অহরহ। এই সমস্যা সমাধান ও নাগরিকদের তথ্য আরও সুরক্ষিত রাখতে জাতীয় পরিচয়পত্রের বদলে স্মার্টকার্ড দেওয়ার প্রকল্প হাতে নিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
১৬ ডিসেম্বর থেকেই নাগরিকদের হাতে পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল এই কার্ড। কিন্তু তথ্য প্রযুক্তিসমৃদ্ধ এই কার্ড করার কাজ সময়মতো শেষ হচ্ছে না সেটা এখন নিশ্চিত প্রায়। আগামী বছরের মার্চে স্মার্টকার্ড বিতরণ করা হতে পারে বলে ইসি জানায়।
নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ এই সময়কে বলেন, ‘স্মার্টকার্ডের ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের অনুমোদনের জন্য অনেক আগেই আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু এখনো অনুমোদন আসেনি। অনুমোদন না আসা পর্যন্ত এখনো কাজে হাতও দিতে পারছি না।’
নির্বাচন কমিশনের সচিব সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘২০১১ সালে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ‘আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম ফর এনহান্সড অ্যাক্সেস টু সার্ভিস বা আইডিইএ প্রকল্প হাতে নেয় ইসি। এ জন্য বাংলাদেশ সরকার ২০১১ সালের ২১ জুলাই বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে একটি চুক্তি সই করে। তবে ডিসেম্বরে স্মার্টকার্ড দেওয়ার কথা থাকলেও পাইলটিং করা সম্ভব হচ্ছে না। বিশ্বব্যাংকের অনুমোদনের পর যদি সব কিছু ঠিক থাকে তাহলে ২০১৫ সালের মার্চের যেকোনো সময় স্মার্টকার্ড বিতরণ করা হতে পারে।’
বর্তমানে সারা দেশে ভোটার ৯ কোটি ১৯ লাখ ৫০ হাজার ৬৪১ জন। হালনাগাদে বেড়েছে আরো প্রায় ৪৭ লাখ ২৬ হাজার।
প্রতি কার্ডে এক থেকে দুই ডলার খরচ হতে পারে বলে জাতীয় পরিচয় অণুবিভাগের সহকারী পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম এই সময়কে জানান। তিনি বলেন, স্মার্টকার্ড করার এক মাস আগে নাগরিকদের জাতীয় পরিচয়পত্রে ভুল সংশোধনের জন্য সুযোগ দেওয়া হবে। কারণ প্রায় দেড় কোটি ভোটারের জাতীয় পরিচয়পত্রে ভুল রয়েছে। আর ভুল সংশোধন আগে না করলে স্মার্টকার্ডেও ভুল থেকে যাবে। এছাড়া একটি আইডি কার্ড তৈরি করতে যেহেতু এক থেকে দুই ডলার করে খরচ পড়বে তাই স্মার্টকার্ড সংশোধন করতে হলে নির্দিষ্ট হারে ফি জমা দিতে হবে ভোটারকে।
স্মার্টকার্ডের প্রকল্প ব্যয় ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার বেশি। প্রতি মাসে ৬০ লাখ করে কার্ড বিতরণের চিন্তা আছে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনের সচিব সিরাজুল ইসলাম। প্রথমে বিনামূল্যে সব পরিচয়পত্রধারীকে স্মার্টকার্ড দেওয়া হলেও এটা সংশোধন বা হারিয়ে গেলে নতুন কার্ডের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ গুনতে হবে।
উপজেলা পর্যায়ে সার্ভার স্টেশনের জন্য ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্কের (ভিপিএন) কাজও এখনো শেষ হয়নি। আগামী মাসেই সার্ভার স্টেশনগুলোর সরঞ্জাম কেনা হবে বলে ইসি সূত্রে জানা যায়। কমিশনের কেন্দ্রীয় স্টেশনের সঙ্গে উপজেলায় স্থাপিত সার্ভার স্টেশনগুলোর সংযোগ স্থাপন করা গেলে সহজেই নাগরিকরা ভোটার হতে পারবে।
এ বিষয়ে এনআইডির মহাপরিচালক সুলতানুজ্জামান মো. সালেহ উদ্দীন বলেন, ‘জানুয়ারি থেকেই সার্ভার স্টেশনগুলোর কার্যক্রম শুরু হবে। সার্ভার স্টেশনগুলোর যন্ত্রপাতি এবং সংযোগ স্থাপন সংক্রান্ত ভিপিএন কার্যক্রম শেষ পর্যায়ে রয়েছে। উপজেলায় সার্ভার স্টেশনের সংযোগ চালু হলে সহজেই ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তি, সংশোধন, হারিয়ে যাওয়া কার্ড তোলা যাবে।’

স্মার্টকার্ড কি?
জালিয়াতি রোধে জাতীয় পরিচয়পত্রকে আধুনিকভাবে তৈরি, যন্ত্রে পাঠযোগ্য জাতীয় পরিচয়পত্রকেই স্মার্টকার্ড বলে। একে ভোটার আইডি বলেও অভিহিত করা হয়। বর্তমানে যে পরিচয়পত্র বা কার্ড চালু রয়েছে তা সাধারণ পাতলা কাগজে প্রিন্ট করে লেমিনেটিং করা। যার প্রথম পৃষ্ঠায় নিজের নাম, পিতা-মাতার নাম, জন্ম তারিখ ও আইডি নম্বর এবং অপর পৃষ্ঠায় ঠিকানা দেওয়া। ফলে এই কার্ডটি সহজেই নকল করা সম্ভব। অসাধু ব্যক্তিরা এটি সহজেই নকল করে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করছে। ফলে নাগরিক ভোগান্তি ও হয়রানি বাড়ছে। এটি রোধ করতেই স্মার্টকার্ড তৈরির প্রকল্প হাতে নিয়েছে ইসি।
এটি যন্ত্রে পাঠযোগ্য। অসাধু ব্যক্তিরা সহজেই নকল করতে পারবে না। ভোটারের বা পরিচয়পত্রধারীর আইডি নম্বর ঠিকানাসহ যাবতীয় তথ্য এই আইডিতে সংরক্ষিত থাকবে। শুধুমাত্র যন্ত্রের সাহায্যে এসব তথ্য পাঠ করা যাবে। টেকসই ও সুন্দর অবয়বে এ কার্ড বহুমুখী ব্যবহারযোগ্য হওয়ায় তা সাধারণভাবে স্মার্টকার্ড হিসেবেই বিবেচিত হবে।

স্মার্টকার্ডের গুরুত্ব বাড়াতে ফি
ব্যয়বহুল হওয়ায় স্মার্টকার্ড কিংবা জাতীয় পরিচয়পত্রের গুরুত্ব নাগরিকদের কাছে বাড়াতে এবার ‘ফি’ নির্ধারণ করতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়। পরিচয়পত্র হারানো, সংশোধন ও স্থানান্তরের ক্ষেত্রে বর্তমানে কোনো ফি না লাগলেও আগামীতে এনআইডি পেতে ‘ফি’ বাধ্যতামূলক করা হবে।
কমিশনের নির্ধারিত ব্যাংকে টাকা জমা দিয়ে এ সেবা নিতে হবে ভোটারদের। এক্ষেত্রে এনআইডি কর্তৃপক্ষের পছন্দ ‘ট্রাস্ট ব্যাংক’ এমনকি অনলাইনেও এটা করার সুযোগ রাখা হচ্ছে।
তবে প্রথমবারের জন্য বিনামূল্যে স্মার্টকার্ডের জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়া হবে। নির্বাচন কমিশন (ইসি) কর্তৃক প্রণীত জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন বিধিমালা-২০১৪ এ বিধান রাখা হয়েছে।
বিধিমালা ও প্রবিধিমালায়-২০১৪তে জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন সংশোধনী আনা হচ্ছে। সংশোধনে সংযোজন করা হচ্ছে ‘কমিশন যেদিন থেকে চাইবে, ওইদিন থেকে ফি বলবৎ হবে।’ কমিশন সচিবালয়ের আইন শাখা বর্তমানে আইনের ত্রুটি খতিয়ে দেখছে।
ইসির কর্মকর্তারা জানান, পরিচয়পত্র হারানো, সংশোধন ও ভোটার স্থানান্তরে বর্তমানে কমিশন কোনো ‘ফি’ নেয় না। তাই দেখা যাচ্ছে পরিচয়পত্রের গুরুত্ব পরিচয়পত্রধারীরা উপলব্ধি করতে পারেন না। যেখানে- সেখানে ফেলে রাখেন পরিচয়পত্র। ফলে প্রয়োজনের সময় আর খুঁজে পান না। পরে থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করে এর কপি এনআইডি অফিসে জমা দিয়ে বিনামূল্যে নতুন আরেকটি পরিচয়পত্র তুলে নেন। একই ব্যক্তির একাধিকবার কার্ড হারানোর নজির আছে।
তাই বারবার আইডি হারানোতে লাগাম টানতে এবার ‘ফি’ নির্ধারণ করা হচ্ছে। যতবার হারাবেন ততবার উত্তোলন করার সময় অর্থ জরিমানার পরিমাণ বাড়তি গুনতে হবে পরিচয়পত্রধারীকে।
জাতীয় পরিচয়পত্র নবায়নের ক্ষেত্রে সাধারণ ১০০ টাকা, জরুরি ১৫০ টাকা, হারানো বা কোনো কারণে নষ্ট হলে প্রথমবারের জন্য ২০০ টাকা, জরুরি ৩০০ টাকা। দ্বিতীয়বার ৩০০ টাকা, জরুরি ৫০০ টাকা এবং পরে যে কোনো বারের জন্য সাধারণ ৫০০ টাকা এবং জরুরি ১ হাজার টাকা করে নেওয়া হবে।
জরুরি আবেদনের ক্ষেত্রে ৭ কার্যদিবস এবং সাধারণ আবেদনের ক্ষেত্রে আবেদন করার ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে জাতীয় পরিচয়পত্র দিতে হবে।
এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ এই সময়কে বলেন, এই কার্ড যন্ত্রে পাঠযোগ্য হওয়ায় পরিচয়পত্র নিয়ে জালিয়াতি কমে যাবে। তাছাড়া অর্থ আদায় বড় বিষয় নয়, নাগরিকরা পরিচয়পত্রটি হাতে পেয়ে যাতে যতœসহকারে ব্যবহার করেন সেটি নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। একটি কার্ড তৈরিতে যে খরচ হচ্ছে, সে তুলনায় ফি ধরা হয়েছে খুবই কম। এটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে জনগণকে সচেতন করতেই ফি নির্ধারণ করা হয়েছে।

অনলাইনেও থাকছে ভুল সংশোধনের সুযোগ
কমিশন যে জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন বিধিমালার খসড়া করেছে তাতে প্রথমবারের মতো অনলাইনে ভোটার হওয়ার সুযোগ থাকছে। কমিশনের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে অনলাইনে ভোটার হওয়ার আবেদন করার সুযোগ থাকবে। এমনকি যারা ভোটার তালিকাভুক্ত নন, তারাও জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্য অনলাইনে আবেদন করতে পারবেন।
ভোটারদের দুর্ভোগ কমাতে নাগরিকদের হাতে স্মার্টকার্ড দেওয়ার আগে চলতি বছরের ডিসেম্বরে অনলাইনে বিশেষ সফ্টওয়ারের মাধ্যমে জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধনের সুযোগ দিতে যাচ্ছে কমিশন। এ জন্য একটি সফ্টওয়ার তৈরি করা হয়েছে। সংশোধনের ক্ষেত্রে যাতে হ্যাকার বা অন্য কেউ তথ্য নষ্ট করতে না পারে সে দিকটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
এ বিষয়ে সিরাজুল ইসলাম বলেন, শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই অনলাইনে ভোটারদের তথ্য সংশোধনের সুযোগ দেওয়া হবে। তারপরও যদি কোনো কারণে তথ্য চুরি বা নষ্ট হয় তাহলে বিকল্প সার্ভার ব্যবহার করবে ইসি। যাতে নাগরিকদের মূল্যবান তথ্যের শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়।

সারা দেশে নতুন ভোটার ৪৭ লাখ
সারা দেশে ২০১৪ সালের ভোটার তালিকা হালনাগাদে ধারণার চেয়েও বেশি ভোটার নিবন্ধিত হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) এবারের ভোটার তালিকা হালনাগাদে ৪৬ লাখ নতুন ভোটার অন্তর্ভুক্ত হবে বলে ধারণা করেছিল। বিভিন্ন উপজেলা থেকে পাঠানো প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সারা দেশে এ পর্যন্ত ৪৭ লাখ ২৬ হাজার ভোটার নাম তালিকাভুক্ত করেছে।
গত ১৫ মে থেকে শুরু হওয়া এই হালনাগাদের কার্যক্রম গত ১৫ নভেম্বর তিনটি ভিন্ন ধাপে শেষ করে ইসি। তথ্য সংগ্রহ, ছবি তোলা ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। কোন এলাকায় কতজন ভোটার তাদের নাম তালিকাভুক্ত করেছে তার একটি রিপোর্ট বিভিন্ন উপজেলা থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অণুবিভাগে এসেছে। কিন্তু নিবন্ধনকৃত সব ভোটারের যাবতীয় তথ্য এখনো পৌঁছেনি বলে জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অণুবিভাগ থেকে জানানো হয়।

স্মার্টকার্ডের ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের অনুমোদনের জন্য অনেক আগেই আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু এখনো অনুমোদন আসেনি। অনুমোদন না আসা পর্যন্ত এখনো কাজে হাতও দিতে পারছি না।
মো. শাহনেওয়াজ
নির্বাচন কমিশনার
২০১১ সালে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম ফর এনহান্সড অ্যাক্সেস টু সার্ভিস বা আইডিইএ প্রকল্প হাতে নেয় ইসি। এ জন্য বাংলাদেশ সরকার ২০১১ সালের ২১ জুলাই বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে একটি চুক্তি সই করে। তবে ডিসেম্বরে স্মার্টকার্ড দেওয়ার কথা থাকলেও পাইলটিং করা সম্ভব হচ্ছে না। বিশ্বব্যাংকের অনুমোদনের পর যদি সব কিছু ঠিক থাকে তাহলে ২০১৫ সালের মার্চের যেকোনো সময় স্মার্টকার্ড বিতরণ করা হতে পারে।
সিরাজুল ইসলাম
সচিব, নির্বাচন কমিশন

Facebooktwitterredditpinterestlinkedinby feather
Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।