শেষ তিন মাসে প্রাথমিকে ৩০ শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা

ডেস্ক: গত ২০১৬ সালের শেষ তিন মাসে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের শারীরিক, মানসিক শাস্তি ও যৌন হয়রানির অভিযোগে সারা দেশে ৩০ জন শিক্ষ-শিক্ষিকার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে শারীরিক শাস্তির ঘটনায় ২৮ জনকে, মানসিক ১ জনকে ও যৌন হয়রানির অভিযোগে একজন শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত, বিভাগীয় মামলা, বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট স্থগিত, বদলি প্রভৃতি শাস্তি দেয়া হয়।

গত বছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি প্রদানসংক্রান্ত এই সমন্বিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তর। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত সচিব পরিচালক (পলিসি ও অপারেশন) সঞ্জয় কুমার চৌধুরী স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে বুধবার এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।

প্রতিবেদনের তথ্যগুলো প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ভুক্ত মাঠপর্যায়ের অফিসগুলো থেকে নেয়া হয় বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি চট্টগ্রাম বিভাগে ১৫ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা শাস্তি পেয়েছেন। পাঁচজন করে শাস্তি পেয়েছেন ঢাকা ও সিলেট বিভাগে। এ ছাড়া বরিশাল, খুলনা, রংপুর ও রাজশাহী বিভাগে একজন করে শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়।

জেলাভিত্তিক সবচেয়ে বেশি শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে লক্ষ্মীপুর ও সুনামগঞ্জে। লক্ষ্মীপুরে দুটি স্কুলের পাঁচজন এবং সুনামগঞ্জে তিন স্কুলের চারজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে নেয়া হয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা।

ঢাকা বিভাগের পাঁচটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ঘটনায় শাস্তিপ্রাপ্ত শিক্ষক-শিক্ষিকারা হলেন- নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার ১০ নং ধন্দী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা জান্নাতুল ফেরদৌস (সাময়িক বরখাস্ত), ফরিদপুর জেলার সদর উপজেলার ভাটিলক্ষ্মীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক গোলজার হোসেন (সাময়িক বরখাস্ত), একই জেলার নগরকান্দা উপজেলার কোদালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মিজানুর রহমান (সাময়িক বরখাস্ত), ঢাকা জেলার ধামরাই উপজেলার রৌহ্রা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মহিউদ্দীন (১টি ইনক্রিমেন্ট স্থগিত), টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর উপজেলার পোস্টকামুরী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আব্দুল করিম (বদলি)।

9kAচট্টগ্রাম বিভাগের ১৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ঘটনায় শাস্তিপ্রাপ্ত যে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নাম প্রতিবেদনে উঠে এসেছে তারা হলেন- চট্টগ্রামের পাহাড়তলি উপজেলার দক্ষিণ কাট্টলী প্রাণহরি মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ইশরাক আহমেদ (চট্টগ্রাম বিভাগের বাইরে বদলির জন্য প্রতিবেদন), একই উপজেলার সারাইপাড়া হাজী আব্দুল আলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. সিরাজুল মোস্তফা (প্রশাসনিক বদলির সুপারিশ), লক্ষ্মীপুর জেলার সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর ঈদগাহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা রেহানা আফরোজ (সতর্কতা) ও রাহেনা আক্তার (বিভাগীয় মামলা রুজু), লক্ষ্মীপুর জেলার সদর উপজেলার প্রতাপগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা পুতুল রানী সাহা (সতর্কতা), অর্চনা রানী সাহা (সতর্কতা), জয়শ্রী রানী মজুমদার (সতর্কতা), চাঁদপুরের সদর উপজেলার কে আর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা শাহজাদী সাবিহা আক্তার (১টি ইনক্রিমেন্ট স্থগিত), হাজিগঞ্জ উপজেলার রামচন্দ্রপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিত্য লাল দেবনাথ (১টি ইনক্রিমেন্ট স্থগিত), ফরিদগঞ্জ উপজেলার শ্রীকালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মহিউদ্দীন (তিরস্কার), রাঙামাটি জেলার নানিয়ারচর উপজেলার পুলিপারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সম্পদ কর (বিভাগীয় মামলা রুজুর জন্য প্রতিবেদন), বরকল উপজেলার বরকল মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক লক্ষ্মীনাথ চাকমা (বিভাগীয় মামলা রুজুর অনুমোদনের নথি প্রেরণ), নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার রসুলপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা মুক্তা রানী কর (বিভাগীয় মামলা রুজু), একই বিদ্যালয়ের শিক্ষক কনক চন্দ্র দাস (বিভাগীয় মামলা রুজু), সেনবাগ উপজেলার জয়নুল আবেদিন ফারুক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক অলি উল্লাহ (১টি ইনক্রিমেন্ট ২ বছরের জন্য স্থগিত)।

বরিশাল বিভাগের পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলার ধাউড়াভাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আব্দুল লতিফ (তদন্ত চলমান)।

সিলেট বিভাগের পাঁচটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ঘটনায় শাস্তিপ্রাপ্ত শিক্ষক-শিক্ষিকারা হলেন- সিলেট জেলার গোয়াইনঘা্ট উপজেলার উপরগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা আমিনা বেগম (অন্য বিদ্যালয়ে বদলিসহ বিভাগীয় মামলা রুজু), সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলার গোবিন্দগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আতিকুল ইসলাম (সাময়িক বরখাস্তসহ বিভাগীয় মামলা রুজু), কুমনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আশিকুর রহমান (কারণ দর্শানো ও বিভাগীয় ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন), সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার পৈন্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. আলী হোসেন (বিভাগীয় মামলা রুজু), জগন্নাথপুর উপজেলার বাগময়না সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. ফরিদ উদ্দীন (বিভাগীয় মামলা রুজু)।

রংপুর, খুলনা ও রাজশাহীর ৪টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ঘটনায় শাস্তিপ্রাপ্ত যে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নাম প্রতিবেদনে উঠে এসেছে তারা হলেন- রংপুর বিভাগের ঠাকুরগাঁও জেলার রাণীশংকৈল উপজেলার পারকুন্ড সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. রেজাউল করিম (বদলি), উলিপুর উপজেলার মহিদেব (নব) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. জাহাঙ্গীর আলম (সাময়িক বরখাস্তসহ বিভাগীয় মামলা রুজু), খুলনা বিভাগের বাগেরহাট জেলার ফকিরহান উপজেলার জারিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা খাদিজা আক্তার (কৈফিয়ত তলব), রাজশাহী বিভাগের পাবনা জেলার চটমোহর উপজেলার রামনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক শাহিনুর রহমান (বদলি)।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শারীরিক শাস্তির বিষয়ে বাংলাদেশ লিগ্যাল অ্যাইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) একটি বুকলেটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শারীরিক শাস্তি আমাদের দেশে দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে। কিন্তু আমাদের এটা বুঝতে হবে যে, ভয় দেখিয়ে নয় ভালো কাজের স্বীকৃতি দিয়ে শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলতে হবে। বাচ্চাদের সামনে নেতিবাচক শৃঙ্খলা নয়, ইতিবাচক শৃঙ্খলা দেখাতে হবে।’

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক শাস্তি বন্ধের নির্দেশনা দিয়ে ২০১০ সালের ৯ আগস্ট একটি পরিপত্র জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর আগে ২০০৮ সালের ২১ এপ্রিল শিক্ষার্থীদের প্রতি সঠিক আচরণ বা ব্যবহারের জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে জারি করা একটি পরিপত্র।

Facebooktwitterredditpinterestlinkedinby feather
Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।