মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে বিতর্ক, সমাধান খুঁজতে হবে শিগগির

শেখ আদনান ফাহাদ,৬ মার্চ ১৭: বাংলাদেশে হেন কোনো বিষয় নেই, যা নিয়ে বিতর্ক নেই। ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক আছে, নির্বাচনী পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক আছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে পর্যন্ত বিতর্ক আছে। নানা বিতর্ক নিয়েই বাংলাদেশ এগুচ্ছে। বিপদজনক বিষয় হল,নতুন প্রজন্ম জাতীয় নানা ইস্যুতে ঐকমত্যে আসতে পারছেনা। প্রজন্ম যদি বিরোধ নিয়ে বড় হয় তাহলে জাতির জন্য কোনোভাবেই মঙ্গলজনক হতে পারেনা। পুরনো হলেও নতুন করে সামনে এসেছে সরকারি চাকরিতে কোটা ইস্যু।

বিশেষ করে, দৃষ্টিকটু এবং অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্ক চলছে মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে। মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা সম্প্রতি মানববন্ধন করেছে। কোটা পদ্ধতিতে যে কোনো সংস্কারের  বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের এই সন্তানরা।

২০১০ সালে মন্ত্রিসভা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে সংশ্লিষ্ট পদ সংরক্ষণ করতে হবে। পরের বিসিএসের মাধ্যমে এই শূন্যপদ মুক্তিযোদ্ধা কোটার মাধ্যমেই পূরণ করতে হবে। কিন্তু পরের বিসিএসের মাধ্যমেও মুক্তিযোদ্ধা কোটার শূন্যপদ পূরণ করা যায়নি। কিছু পদ দীর্ঘদিন শূন্য থেকেছে। তখন সরকারকে কোটা সংরক্ষণের নিয়ম শিথিল করার অনুরোধ করা হলে মন্ত্রিসভা শুধু একটি বিসিএসের জন্য কোটার শূন্যপদ সংরক্ষণ করার নিয়ম শিথিল করার সিদ্ধান্ত নেয়।

সম্প্রতি পিএসসির চেয়ারম্যান ড.সাদিকের ওপর চরম ক্ষুব্ধ হয় মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা। মানববন্ধন করে তারা ড. সাদিকের অপসারণের দাবি জানায়। অভিযোগ করা হয়, পিএসসির চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা পরিবারগুলোকে দুর্বল করার অপচেষ্টা চালাচ্ছেন!

বিসিএসে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে শূন্য পদগুলো মেধা তালিকায় থাকা সাধারণ প্রার্থীদের দিয়ে পূরণ করা হবে মর্মে মন্ত্রিসভার বৈঠকে নেওয়া সিদ্ধান্ত অনতিবিলম্বে পরিবর্তনের দাবি জানান মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা।

মানববন্ধনে ফোরামের নেতৃবৃন্দ বলেন, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের সুযোগ সংকুচিত করার কোনো সুযোগ নেই। ‘মুক্তিযোদ্ধা সন্তানরা’ মেধাবী নন, নানা পর্যায়ে এমন ঢালাও পর্যবেক্ষণের বিষয়েও তীব্র প্রতিবাদ জানান।

পিএসসির চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক একটি জাতীয় দৈনিককে বলেছিলেন, মুক্তিযোদ্ধা কোটার পদ সংরক্ষণ করার নিয়ম ৩৬তম বিসিএসের জন্য শিথিল করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কারণ শিথিল করা না হলে অনেক পদ শূন্য থেকে যাবে। বিশেষ করে কারিগরি ও পেশাভিত্তিক ক্যাডারের পদ শূন্য থাকবে।

২৮তম থেকে ৩১তম এবং ৩৩তম থেকে ৩৫তম বিসিএসে সাধারণ ক্যাডারগুলোর ক্ষেত্রে শূন্যপদের চেয়ে কৃতকার্য প্রার্থী বেশি থাকায় ওই সব ক্যাডারের মুক্তিযোদ্ধা, নারী ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটায় কোনো পদ খালি থাকেনি। কিন্তু কারিগরি ও পেশানির্দিষ্ট ক্যাডারের বিশেষ করে চিকিৎসা, কৃষি, মৎস্য, পশুপালন, প্রকৌশল ও শিক্ষকতা ক্যাডারে মুক্তিযোদ্ধা, নারী ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটায় পদের চেয়ে কৃতকার্য প্রার্থীর সংখ্যা কম ছিল। ফলে এসব কোটার সব পদ পূরণ করা যায়নি।

৩৬তম বিসিএসে দুই হাজার ১৮০টি শূন্যপদে লোক নিয়োগ করা হবে। এর লিখিত পরীক্ষা শেষ হয়েছে। ফলাফল তৈরির কাজ চলছে। এ বিসিএসে চিকিৎসা, কৃষি, প্রকৌশল, মৎস্য, পশুপালন ও শিক্ষকতা ক্যাডারের পদ এক হাজার ৬৩৮টি। এসবের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কোটার ৪৯১টি (৩০ শতাংশ), নারী কোটার ১৬৪টি (১০ শতাংশ) ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটার ৮২টি (৫ শতাংশ) পদ রয়েছে। এই ৭৩৭টি পদের অধিকাংশই খালি থাকবে। ফলে সংশ্লিষ্ট দপ্তর বা অধিদপ্তর কর্মকর্তার অভাবে পড়বে বলে সেই দৈনিকের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়।

পত্রিকাটি জানায়, সরকারের কাছে পাঠানো চিঠিতে পিএসসি বলেছে, কিছু ক্ষেত্রে প্রার্থী কম থাকায় মেধা কোটার সব পদও পূরণ করা সম্ভব হয় না। মুক্তিযোদ্ধা কোটার পদ সংরক্ষণের নিয়ম থাকায় কারিগরি ও পেশাগত ক্যাডারের মুক্তিযোদ্ধা কোটার অপূরণকৃত পদ সাধারণ প্রার্থীদের মেধাতালিকা থেকে পূরণ করা যায় না।

পিএসসিতে কথা বলে জানা গেছে,  সমালোচনা ও প্রতিবাদ হওয়ায় সরকার মুক্তিযোদ্ধা কোটা বিষয়ে কোনো সংস্কারের পথে যাচ্ছেনা। আপাতত না হয় গেলনা। তাই বলে সামনের বিসিএস পরীক্ষাগুলোতে সরকার এই পথে যাবেনা এমনটা নিশ্চিত করে বলা যায়না।  অথবা সরকার পরিবর্তন হলে এই কোটা বাতিল করা হবে না, তাও বলা যায়না। এ নিয়ে খোদ আওয়ামী লীগ সমর্থকদের ভেতরেই পক্ষ-বিপক্ষ আছে। যার বাবার মুক্তিযোদ্ধা সনদ আছে সে পক্ষে বলে, যার বাবার নেই সে মনে করে, সনদের জোরে কেউ কেউ বাড়তি সুবিধা পাচ্ছে। ফলে এক ধরনের বিরোধ নিয়ে প্রজন্ম বড় হচ্ছে। এই বিরোধ মোটেও কাম্য নয়। মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। কিন্তু এই অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্ক যে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানহানির কারণ হচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

মুক্তিযোদ্ধার সন্তানেরা কেন বাড়তি সুবিধা পাবে? এমন প্রশ্ন অনেকে করেন। এ প্রশ্নের উত্তর খুব সহজ। মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্র উপহার দিয়েছেন। ফলে তাদের সন্তানরা একটু বাড়তি সম্মান, সুবিধা পাওয়ার অধিকার রাখেন। বলা হয় যে মুক্তিযুদ্ধের সময় অল্পসংখ্যক রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস ছাড়া সবাই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। কিন্তু যুদ্ধ এত সরল বিষয় না। যারা যুদ্ধ পরিকল্পনা করেছেন, পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অর্থ-অস্ত্র সংগ্রহ করেছেন,  মুজিবনগর সরকারের হয়ে কোনো না কোনোভাবে কাজ করেছেন, সশস্ত্র যুদ্ধে যারা গিয়েছেন, শহীদ হয়েছেন বা গাজী হিসেবে বেঁচে আছেন, মুক্তিযোদ্ধা শিবিরগুলোতে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, গায়ে গতরে কোনো না কোনোভাবে যুদ্ধের সাথে সম্পৃক্ত থেকেছেন তারাই আসলে মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে যারা কাজ করেছেন, গান গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করেছেন, বেতার যোগাযোগ জারি রাখতে প্রকৌশল সেবা দিয়েছেন, যারা আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন, মুক্তিযোদ্ধা শিবিরগুলোতে রাজনৈতিক ইন্সট্রাক্টরের কাজ করেছেন। মুক্তিযোদ্ধা শিবিরে যারা রান্নাবান্নার কাজ করে খাবার যোগান দিয়েছেন সবাই মুক্তিযোদ্ধা। এখন প্রশ্ন হল, উপরোক্ত কাজগুলো কতজন করেছেন?

মুক্তিযোদ্ধারা খুবই স্পেশাল। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান রাষ্ট্রে বেশিই থাকবে এটাই স্বাভাবিক। ৯ মাস বাড়ি-ঘর থেকে দূরে থাকায় কত পরিবার ছন্নছাড়া হয়ে গেছে। যারা যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন তাদের পরিবার তো পথে বসে গিয়েছিল। গাজী হয়ে যারা বেঁচে আছেন, তাদেরও অনেক পরিবারের দুর্দশা কাটতে অনেক সময় নিয়েছে। এখনো অনেক পরিবার দৈন্যদশায় আছে। এদেশে গরিব রাজাকার পাওয়া মুশকিল হবে। কিন্তু হতদরিদ্র মুক্তিযোদ্ধা মিলবে ভূরি ভূরি। ফলে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারগুলোকে পুনর্বাসন করা, বাড়তি সুবিধা দেয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কিন্তু এই সেনসিটিভ দিকটিরই ফায়দা নিয়েছে কিছু শিক্ষিত টাউট।  এদেশে সচিব পর্যন্ত, তাও আওয়ামী লীগের আমলে, ভুয়া সনদ বানিয়ে সুবিধা নিয়ে ধরা পড়েছেন। অনেককে দেখেছি, বাবা/চাচার জন্য সনদ ম্যানেজ করার জন্যই শুধু ক্ষমতাসীন নানা সংগঠনের সাথে জড়িত হয়েছেন। একসময় তো  সনদ বানানোর হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। আজ পর্যন্ত রাষ্ট্র মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞাই নির্ধারণ করতে পারেনি। জামায়াতে ইসলামীর পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট আছে এদেশে! মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে বিতর্কের এগুলোও কিছু কারণ। এখন তো বলা হয়, ‘মুক্তিযোদ্ধা’ দুই প্রকার- আসল এবং ভুয়া!

এই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে বের করতে হবে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের চিহ্নিত করে তালিকা তৈরি করে একটা স্থায়ী ডকুমেন্ট তৈরি করতে হবে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি করা গেলে কোটা বিতর্ক অবসানে অনেকখানি আগানো যাবে বলে আমার ধারণা। কিন্তু কবে হবে, আওয়ামী লীগ গত ৮ বছর ধরে রাষ্ট্রক্ষমতায়। অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করলেও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা বিষয়ে তেমন কোনো অর্জন নেই। রাজাকার তালিকা তৈরির দাবিও অনেক দিনের। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি।

তবে মুক্তিযোদ্ধা  বা রাজাকার তালিকার সাথে কোটা বাতিলের কী সম্পর্ক সেটা অবশ্য চট করে বোঝা সহজ নয়। একটু গভীরভাবে ভাবলে এ কথার মর্মার্থ অনুধাবন করা যাবে। কিন্তু কোটা নিয়ে বিতর্কের অবসান ঘটাতেই হবে। কীভাবে করা হবে, রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকদের ভাবতে হবে। কিন্তু প্রজন্মকে বিতর্কের মধ্যে ফেলে রাখা যাবেনা। এত অশ্রদ্ধা, অবিশ্বাস নিয়ে থাকা যায়না।

লেখকঃ সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

Facebooktwitterredditpinterestlinkedinby feather
Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।