বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ তালিকায় হ-য-ব-র-ল

বেসরকারি স্কুল-কলেজে কেন্দ্রীয়ভাবে শিক্ষক নিয়োগের তালিকা প্রকাশের পর বিপাকে পড়েছেন চাকরিপ্রার্থীরা। ৯ অক্টোবর ১২ হাজার ৬১৯ জন শিক্ষকের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। তাতে দেখা যায়, অনেক ক্ষেত্রে একজন শিক্ষককে পাঁচ, দশ বা তারও বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে। অন্যদিকে কোনো কোনো শিক্ষক অর্ধশতাধিক থেকে শতাধিক আবেদন করেও কোনো স্কুল বা কলেজে নিয়োগের জন্য যোগ্য বিবেচিত হননি। ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করে বলছেন, একজন চাকরিপ্রার্থী মাত্র একটি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাবেন। কিন্তু অনেককেই একাধিক পদের জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে। এতে বেকাররা বেকারই থেকে গেল! এ ছাড়া শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে নিজ উপজেলা, জেলাকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা থাকলেও এমনটি মানা হয়নি। মহিলা কোটাও অনুসরণ করা হয়নি যথাযথভাবে। তবে এসব বিষয়ে জানতে এনটিআরসিএ’র চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম আজহারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, একাধিক স্কুল বা কলেজে চাকরির জন্য সুপারিশপ্রাপ্তদের পছন্দমাফিক মাত্র একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যোগদানের সুযোগ দিয়ে পুনরায় আরেকটি তালিকা তৈরি করা হবে। এ ব্যাপারে আমরা একটি প্রক্রিয়া শিগগিরই শুরু করব। কোটা অনুসরণ না করা, নিয়োগে এলাকা প্রাধান্য না দেওয়াসহ ভুক্তভোগী প্রার্থীদের অভিযোগের উত্তর না দিয়ে ফোন কেটে দেন তিনি। এদিকে নানা অনিয়ম আর অভিযোগ তুলে নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ কিন্তু চাকরির সুপারিশ না পাওয়া প্রার্থীরা এনটিআরসিএ’র চেয়ারম্যান ও শিক্ষা সচিব বরাবর দেশের ৬৪ জেলা থেকে উকিল নোটিস পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এ লক্ষ্যে ২০-২৫ জন চাকরিপ্রার্থী বৃহস্পতিবার রাজধানীর রমনা পার্কে বৈঠক করেছেন। নিবন্ধনধারী এই বেকারদের সমন্বয় করছেন জাহাঙ্গীর আলম (১২তম নিবন্ধন, রোল ৩১২০৬১৬৫, রেজি. ২০১৫১২০৩২৫৪৭)। তিনি ২৪টি প্রতিষ্ঠানে আবেদন করে কোথাও সিলেক্টেড হননি। জাহাঙ্গীর বলেন, ‘উকিল নোটিসের যথাযথ জবাব না পেলে আমরা এনটিআরসিএ’র চেয়ারম্যান ও শিক্ষা সচিবের বিরুদ্ধে মামলা করব।’ এ ফলাফলের বিরুদ্ধে শিগগিরই হাইকোর্টে রিট করবেন বলেও জানান তারা। মো. গোলাম রাব্বানি রাজশাহীর বাগমারা উপজেলা থেকে অভিযোগ করে বলেন, তিনি (১২তম নিবন্ধন, রেজি. ২০১৫১২০৩৮৭৪০) চাকরি পেতে ৯২টি কলেজে আবেদন করেছেন। পরিতোষচন্দ্র হালদার (১২তম নিবন্ধন, রোল ৪৩৫০০১৯৫) জানান, উদ্যোক্তা উন্নয়ন সাবজেক্টে থেকে তিনি ১২টি কলেজে আবেদন করেছেন। ফরিদপুর থেকে শাখাওয়াত হোসেন জানান, তিনি ১৭টি কলেজে আবেদন করেছেন। ১১তম নিবন্ধনে উত্তীর্ণ হয়েছেন মো. কহিনুর আলম (রেজি. ২০১৪১১০২২৮৪৪)। তিনি ইসলামের ইতিহাস সাবজেক্ট থেকে আবেদন করেছেন ১১টি কলেজে। কুড়িগ্রাম থেকে মো. জাহাঙ্গীর আলম (নবম নিবন্ধন, রোল ৪২২১১২৪০) জানান, তিনি ৩০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আবেদন করেছেন। নীলফামারীর মো. হামিদুল ইসলাম (১২তম নিবন্ধন, রোল ৩০৪০৬৯৮৭) ৪০টি স্কুলে আবেদন করেছেন। কিন্তু কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই নিয়োগের জন্য মনোনীত করা হয়নি এই চাকরিপ্রার্থীদের। শেরপুরের আতিকুর রহমান (রোল ৪১৬০৮৮৯৫) বলেন, ‘আমি উদ্ভিদবিদ্যা বিষয়ে ১১তম শিক্ষক নিবন্ধন লিখিত পরীক্ষায় কলেজে ৮৪ পেয়ে উত্তীর্ণ হই। ১৯টি কলেজে অ্যাপ্লিকেশন করে একটিতেও আমার নাম আসেনি। পদ খালি থাকা সত্ত্বেও ময়মনসিংহ, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি উদ্ভিদবিদ্যায় কোনো পদের চাহিদা দেয়নি এবং এনটিআরসিএ চাহিদা দিতে বাধ্য করেনি। ফলে আমি বেকারই থেকে গেলাম।’ অন্যদিকে অনেক প্রার্থী একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য নির্বাচিত হয়েছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাঙামাটি থেকে বীণাপাণি ধার (ষষ্ঠ নিবন্ধন, রোল ৩২১৩৩২৮৯) চারটি স্কুলে নিয়োগের সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। চট্টগ্রাম জেলার মহসিন আলী (১১তম নিবন্ধন, রোল ৩১৮০৪৫৭৮) নামে এক প্রার্থী ১০টি স্কুলে নিয়োগের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন। ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলায় মীম নামে এক প্রার্থী (দশম নিবন্ধন, রোল ৩২১১৮৫৬৫) আটটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গণিত শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন। এ থানায় কামরুল হাসান নামে (১২তম নিবন্ধন, রোল ৩০২০৩৯৫২) আরেক প্রার্থী ছয়টি স্কুলে ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের জন্য মনোনীত হয়েছেন। ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলায় মাধ্যমিক পর্যায়ে ৭৪টি পদের বিপরীতে মনোনীত প্রার্থীর মধ্যে ৬৭ জনই একাধিক স্কুলের জন্য মনোনীত হয়েছেন বলে জানা গেছে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অধীন ওয়াহেদুল ইসলাম (নবম নিবন্ধন, রোল ৩০২০৫৭৮২) ও রাসেল হোসাইন (১২তম নিবন্ধন, রোল ৩০২০৩৮৭২) নামে দুই প্রার্থী ৭টি করে ১৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিপরীতে শিক্ষক হিসেবে মনোনীত হয়েছেন। নিবন্ধনধারী বেকারদের সমন্বয়ক জাহাঙ্গীর আলম অভিযোগ করে বলেন, সারা দেশের বেসরকারি স্কুল-কলেজে প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয় সব শূন্যপদের তালিকা না নিয়ে মাত্র ১২ হাজার ৬১৯টি পদের বাছাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে। এতে অনেক প্রার্থীই চাকরির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। মহিলা কোটা সংরক্ষণ না করার অভিযোগ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জের রাজারামপুর হাসিনা বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমার স্কুলে শারীরিক শিক্ষায় একজন মহিলা নিয়োগ দিতে শূন্যপদের তালিকা জমা দিই। কিন্তু সে স্থানে মো. গোলাম কবীর (১০ নিবন্ধন, রোল ৩১৮১৬৫২৯) নামে এক পুরুষ প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অথচ আমার উপজেলায় যোগ্য মহিলা প্রার্থীও আবেদন করেছিলেন।’ এ ব্যাপারে এনটিআরসিএ বরাবর একটি লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন বলে জানান তিনি। অভিযোগ রয়েছে, রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার মোহাম্মদ আলী মেমোরিয়াল হাইস্কুলে ইংরেজি সহকারী শিক্ষক পদে দুটি পদে পাশের কাউনিয়া উপজেলা থেকে সিলেক্ট করা হয়েছে। গঙ্গাচড়া উপজেলায় আবেদন করা প্রার্থীরা পদ্মচন্দ্র রয় (১২তম নিবন্ধন), মো. ফাজিয়া শারমিন (১২তম), মোস্তাফিজুর রহমান (১২তম) এ ক্ষেত্রে বঞ্চিত হয়েছেন। চাকরির জন্য সুপারিশ না হওয়া প্রার্থীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘একজন প্রার্থী যত খুশি আবেদন করতে পারবেন’ এমন নিয়ম চালু করে এনটিআরসিএ বেকার যুবকদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। একটি চাকরির জন্য অনেকেই ডজন ডজন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আবেদন করেছেন। তারা বলছেন, বেকার যুবকদের কাছ থেকে এভাবে টাকা আদায় করা প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়।

Facebooktwitterredditpinterestlinkedinby feather
Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।