বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় গড়তে রাবির মাস্টারপ্ল্যান

উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে (রাবি) আরো যুগোপযোগী, মানসম্মত ও সম্পূর্ন ডিজিটালাইজেশনে ঢেলে সাজাতে ৩৬০ কোটি টাকার ৫০ বছর মেয়াদী উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

বিশ্বের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিতে শিক্ষার্থীদের মানোন্নয়নে নেওয়া হচ্ছে মাস্টারপ্ল্যান। উন্নত কারিকুলাম প্রণোয়ন, নিয়োগে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা, পরীক্ষার ফলাফল মূল্যায়ন, নম্বরপত্র ও সনদপত্র দ্রুত উত্তোলন ও ভর্তি পরীক্ষার ভোগান্তি কমানোসহ প্রশাসনিক ও অবকামাঠামোগত যুগান্তকারী পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে প্রশাসন।

শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি, অর্থ সাশ্রয় এবং ঝামেলা কমাতে প্রোগ্রাম ডেভলপ করা হচ্ছে যাতে করে অনলাইনে আবেদন করেই শিক্ষার্থী তার নম্বরপত্র এবং সনদপত্র তুলতে পারেন।

এছাড়া প্রত্যেক বিভাগের ফলাফলও দেখা যাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে ক্লিক করলেই। এতে সময় যেমন কম লাগবে পাশাপাশি ভুল হওয়ার আশঙ্কাও থাকবে কম। এই প্রকল্প চালু করতে প্রকৌশল অনুষদে পাইলট পরিকল্পনা চলছে।

প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, মেধাবী ও যোগ্যদের বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দিতে তিন স্তরের নিয়োগ ব্যবস্থা হাতে নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সম্প্রতি তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগে প্রথমে লিখিত পরীক্ষা দ্বিতীয় পর্যায়ে জব টেস্ট এবং এই তিন স্তর পার করে আসা আবেদনকারী মৌখিক পরীক্ষার মুখোমুখি হবেন।

শুধু তাই নয় তিন পরীক্ষার জন্য আলাদা তিনটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কোন ব্যক্তির হাতে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষমতা না রেখে যোগ্যদের তুলে আনতে এ ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে। আর শিক্ষক নিয়োগে চারটিতে প্রথম শ্রেণি ছাড়া আবেদন না করা যাওয়ায় দুর্নীতি এবং তোষামোদের জায়গাও কমে যাবে বলে দাবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের।

বিদ্যুৎ বিভ্রাট : এটি কমানোর জন্য লোড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম পরিকল্পনা নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এই ব্যবস্থায় পুরো ক্যাম্পাস একসঙ্গে বিদ্যুৎ বিছিন্ন হয়ে অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে না। এই সিস্টেমের আওতায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রথমে ক্লাস ও পরীক্ষা কক্ষে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। এরপর শিক্ষার্থীদের চাহিদা অনুযায়ী আবাসিক হলগুলোতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে।

আবসিক হল : বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫০ বছর মেয়াদী উন্নয়ন পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে শিক্ষার্থীদের জন্য ১০ তলা বিশিষ্ট দুটি আবাসিক হল। বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের পশ্চিম দিকে ১০ তলা বিশিষ্ট শিক্ষকদের জন্য একটি আবাসিক ভবন। প্রতি বছর পর্যায়ক্রমে অনুষদ ও বিভাগ সংখ্যা বৃদ্ধি করার পরিকল্পনা নিয়েছে বর্তমান প্রশাসন। এজন্য ২০ তলা বিশিষ্ট একটি একাডেমিক ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পশ্চিম দিকে নির্মাণ করা হবে ১০ তলা বিশিষ্ট একটি প্রশাসনিক ভবন। বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও কৃষি অনুষদের জন্য আলাদা একটি ডীন্স কমপ্লেক্স গবেষণার জন্য ল্যাব নির্মাণ করা হবে।

শিক্ষক, কর্মকর্তা বৃদ্ধি এছাড়াও একাডেমিক কার্যক্রম উন্নত করার জন্য প্রতিটি বিভাগে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারির সংখ্যা বৃদ্ধি করা হবে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলনায়তন, স্টেডিয়াম ও সুইমিং পুলের কাঠামোগত উন্নয়নের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ সংরক্ষণ, সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি ও জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য নতুন গাছ লাগানো, রাস্তা সংস্কার, ফুটওয়ে নির্মাণ, গাড়ী পার্কিং স্থান নির্মাণসহ বিভিন্ন পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।

বাস স্ট্যান্ড : বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস স্ট্যান্ড প্রাঙ্গণকে আধুনিক করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান নিটোল টাটার তত্ত্বাবধায়নে একটি আধুনিক মানের বাসস্ট্যান্ড ডিজাইন প্রস্তত করা হয়েছে। এই ডিজাইনে বাসস্ট্যান্ড প্রাঙ্গণ সম্পূর্ণ পাকা করা হবে। প্রতি ১০ বছর অন্তর অন্তর নতুন গাড়ি ও চালক সংখ্যা বৃদ্ধি করা হবে।

ড্রেনেজ ব্যবস্থা : পুরো ক্যাম্পাস ড্রেনেজ সিস্টেমের আওতায় নেয়া হচ্ছে। বর্ষাকালে ক্যাম্পাসে কোথাও যাতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি না হয় সেজন্য ক্যাম্পাসের বিভিন্ন দিকে লেক নির্মাণ করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক চর্চা বৃদ্ধি করার জন্য ইতোমধ্যে নির্মাণ করা হয়েছে ছাত্র শিক্ষক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন পরিকল্পনার বিষয়ে প্রো-ভিসি চৌধুরী সারওয়ার জাহান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় এতোদিন চলেছে পরিকল্পনাবিহীন। তাই সবকিছু ঢেলে নিয়মতান্ত্রিকভাবে সাজাতে আমরা মাস্ট্যারপ্ল্যান হাতে নিয়েছি। আর এতে আমরা সরকারের সার্বিক সদিচ্ছার আশ্বাস পেয়েছি। ভর্তি থেকে শুরু করে নিয়োগ সব কিছুতে স্বচ্ছতা আনতে আমাদের হাতিয়ার হল ক্যাম্পাস ডিজিটালাইজেশন।

স্মৃতিস্তম্ভ : বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শহীদ শামসুজ্জোহার স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ভবনের সামনে নির্মাণ করা হয়েছে শহীদ শামসুজ্জোহা চত্ত্বর ও জোহা স্মৃতিস্তম্ভ। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশ করার পরই চোখে পড়ে এই চত্ত্বর ও স্মৃতিস্তম্ভটি। স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণে এক ধরণের প্লেট নির্মাণ করা হয়েছে যাতে প্লেটগুলোতে শ্যাওলা পড়বে না। সারা বছর স্মৃতি স্তম্ভটির সৌন্দর্য্য অটুট থাকবে। ওই স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে এক কোটি টাকা।

রাজশাহী-২ আসনের সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা এই টাকা অনুদান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে দিয়েছেন।

বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলক : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের প্রতিচিত্র, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ, স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে বুদ্ধিজীবী হত্যার হারানো ইমেজ, বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধে শহীদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষক ড. সুখরঞ্জন সমাদ্দার, শহীদ ড. হাবিবুর রহমান ও মীর আব্দুল কাইয়ূমের স্মৃতিকে ধরে রাখতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ভবনের পশ্চিম দিকে নির্মাধীন রয়েছে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলক। প্রায় ৬১ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত হচ্ছে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলকটি।

মুক্তিযুদ্ধ কর্ণার : এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তরুণদের কাছে তুলে ধরতে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে নির্মাণ করা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ কর্ণার। গ্রন্থাগারের মধ্যে একটি মুক্তিযুদ্ধ রিসার্চ সেল করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। সেখানে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সকল ফরম্যাটে তথ্য থাকবে। প্রিন্টেড, ভিডিও, অডিও থাকবে। এগুলো দেখার জন্য স্ক্রিন ও এয়ারফোন থাকবে। এখানে থাকবে সব ধরনের ডিজিটাল সুবিধা। ওই মুক্তিযুদ্ধ রিসার্চ সেল ব্যবহার করবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে গবেষকরা।

ইন্টারনেট সুবিধা : ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের পাশাপাশি পুরো ক্যাম্পাসে নিরবিচ্ছিন্ন করা হয়েছে তারহীন ইন্টারনেট (ওয়াইফাই)। ক্যাম্পাসের শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা, কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তন, রাকসু ভবন, সিনেট ভবন, ডীন্স কমপ্লেক্স, কেন্দ্রীয় গ্রান্থাগার, আবাসিক হল, একাডেমিক ও প্রশাসনিক ভবনগুলোতে এই ইন্টারনেট সেবা পাওয়া যাচ্ছে।

শিক্ষক-শিক্ষাথী, কর্মকর্তা কর্মচারীদের ইস্যু করা স্মার্ট কার্ডের ব্যবহার শুরু হয়েছে। পরিচয়পত্রের পাশাপাশি এ কার্ড ব্যবহার করে বিভিন্ন ফি পরিশোধ, গ্রন্থাগারের বই লেনদেন, ব্যায়ামাগার, চিকিৎসা কেন্দ্রে সেবাসহ মোট ২৮টি কাজে ব্যবহার পর্যায়ক্রমে শুরু হচ্ছে।

এ ব্যাপারে রাবি ভিসি প্রফেসর মিজান উদ্দিন ক্যাম্পাসলাইভকে জানান, ‘২০১৩ সালে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে দায়িত্ব নিই তখন চারদিকে ছিল অব্যবস্থাপনা, নৈরাজ্য, অনুন্নয়ন ও ঋণের বোঝা। সেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে তুলে আনতে আমরা স্বচ্ছতা, যোগ্যতা এবং জবাবদিহিতার ওপর জোর দিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক কাজে ডিজিটালাইজেশনের প্রয়োগে আমরা হাতেনাতে পেয়েছি ফলাফল। আর এর ধারাবাহিকতায় মাস্টারপ্ল্যান হাতে নিয়েছি।

Facebooktwitterredditpinterestlinkedinby feather
Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।