প্রাথমিক মানসম্মত শিক্ষায় বাধা শিক্ষকদের শিক্ষাবহির্ভূত কর্মে সম্পৃক্ত করা

স্বরুপ দাস: দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রের কারণে সমাজে ও পরিবারে নানাবিধ সমস্যা ও অস্থিতিশীলতা বিরাজ করে। ফলে বেশিরভাগ পরিবারে দ্বন্দ্ব ও কলহ বিরাজ করে। যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে সন্তানের ওপর। শিক্ষা সম্পৃক্ত বিষয় তার কাছে উপযোগিতা পায় না। শিক্ষকের পাঠদান তার ভেতরে সেভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। অতি মেধাবী, চঞ্চল ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে দেখা যায়, তারা যদি মেধা অনুযায়ী শিখন পরিবেশ না পায় সেক্ষেত্রেও মেধাবী শিক্ষার্থীদের বিকাশ ব্যাহত হতে পারে। বিদ্যালয়ের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা ও সহযোগিতার জন্য যে ম্যানেজিং কমিটি থাকে তাও অনেক সময় ক্ষুদ্র কোনো বিষয়ে ইস্যু তৈরি করে বিশাল সমস্যায় পরিণত করে। ফলে শিক্ষকরা অনেক সময় অবাঞ্ছিত ও অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হন।


মা-বাবা, বড় ভাই-বোন অনেক সময় খোঁজখবরও রাখেন না। বাবা-মা মনে করেন, জন্ম দেয়ার কাজ ছিল জন্ম দিলাম। মানুষ করার দায়িত্ব শিক্ষকের। শিক্ষক দিকনির্দেশনা দিতে পারেন, পাঠ্য বিষয় বোধগম্য করে দিতে পারেন, প্রকৃত মানুষ হওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত ও উজ্জীবিত করতে পারেন; কিন্তু শিক্ষা অর্জনের প্রাথমিক স্তর হলো পরিবার। পরিবার থেকে যদি শিক্ষার্থী আচরণ না শেখে, মানব চরিত্রের মহত্ গুণগুলো না শেখে, পরিবারেই যদি থাকে অনিয়ম, মিথ্যা, কলহ ও জরাজীর্ণ পরিবেশ—তবে সেই পরিবেশ শিক্ষার্থীর মনে কী প্রভাব ফেলবে তা তো সহজেই অনুমেয়।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই পরিবার থেকে যে সহযোগিতা পাওয়ার কথা তা পায় না। উপরন্তু পরিবারকে শিক্ষার্থীর সহায়তা করতে হয়। সেটা হতে পারে পাতা কুড়িয়ে, লাকড়ি সংগ্রহ করে কিংবা গৃহস্থালির অন্যান্য কাজে। ফলে শিক্ষার্থী বিদ্যালয় থেকে এসে বইগুলো যেভাবে বাড়িতে রাখে, আবার বিদ্যালয়ে আসার পথে সেভাবেই বইগুলো নিয়ে নেয়। বাড়িতে অবস্থানকালে বইগুলো পড়া ও চর্চা করা শিক্ষার্থীর কর্মের পরিসরে পড়ে না। হয়তো খেলাধুলা করে, কাজ করে, ঘোরাফেরা, মারামারি কিংবা কলহ সৃষ্টি করে সময় কাটায়।

প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে  একটি অন্যতম অন্তরায় হচ্ছে শিক্ষকদের শিক্ষাবহির্ভূত কর্মে সম্পৃক্ত করা।উপবৃত্তির কাজ করা,ভোটার তালিকা তৈরি, ছুটির  মধ্যে জরিপ, ক্যাচমেন্ট এলাকার ম্যাপ তৈরি, বিভিন্ন তথ্য ছক পূরণ—এসব কর্মে শিক্ষকদের ওপর বিরাট চাপ পড়ে। এটা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বোঝা উচিত।তাছাড়া শিশু জরীপ প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে কি কাজে লাগে তা বোধগম্য নয়।  একদিকে ছোট ছোট শিশুদের প্রতি দায়িত্ব পালন, বিভিন্ন নির্দেশনা মেনে চলাম তার ওপর এত সব কর্ম—এত নৌকায় পা দিয়ে কোন নৌকায় করে গন্তব্যে যাবেন শিক্ষকরা। শিক্ষকরা সমাজে শ্রদ্ধার পাত্র। জরিপের কাজে, ভোটার তালিকার কাজে কিংবা অন্য কোনো কাজে যখন বিভিন্ন বাড়িতে গমন করেন, তখন অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষকরা অসৌজন্যমূলক আচরণের মুখোমুখি হন।

এটা অবশ্যই আশার কথা, আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় বর্তমানে অনেক যোগ্য লোকের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। যোগ্য লোক যদি যোগ্য জায়গায় স্থান না পায় তবে সেক্ষেত্রেও মরিচা ধরার সন্দেহ উড়িয়ে দেয়া যায় না। অনেক স্বপ্ন ও আশা নিয়ে অনেকে এখানে প্রবেশ করে, পরে নিস্পৃহ হয়ে পড়ে। হারিয়ে যায় আলোর কণাগুলো। এই আলোর বিন্দুগুলোকে হারিয়ে যেতে দেয়া যাবে না। এদের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। বিকশিত করার জন্য অবস্থান তৈরি করতে হবে। তবেই অগ্নিবিন্দু শিখায় শিখায় আলো ছড়াবে। আর এই আলোর সমাহার আমাদের সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে বিশ্বের কাছে পরিচয় করিয়ে দেবে।

স্বরুপ দাস, প্রশি, আজমপুর সপ্রাবি, কেন্দ্রিয় যুগ্ন সিনিয়ার সাধারন সম্পাদক, আহবায়ক খুলনা বিভাগ, সাধারন সম্পাদক, দামুড়হুদা, বাসপ্রাবি প্রধান শিক্ষক সমিতি

Facebooktwitterredditpinterestlinkedinby feather
Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।