প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকরা হতাশ

এস কে দাস: govt-sm20131210134332_25818দিনের পর দিন শিক্ষার আলো বিলিয়ে বেড়ান প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা। অথচ অর্থের অভাবে নিজের ঘরেই আলো জ্বলছে না। ফলে অনেকটা অন্ধকারেই দিনযাপন করতে হচ্ছে তাঁদের। বর্তমান বেতন কাঠামোতে সহকারী শিক্ষকদের সংসার চালানো তো দূরের কথা, নিজের দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে এই মানুষ গড়ার কারিগরদের। সারাদেশের প্রায় তিন লাখ পঞ্চাশ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকের এ অবস্থা। সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের দুই ধাপ ও সহকারী শিক্ষকদের এক ধাপ বেতন বাড়ানোর ঘোষণা দিলেও এখন পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন হয়নি। বর্তমানে প্রশিক্ষণবিহীন সহকারী শিক্ষকরা সর্বসাকুল্যে পান ৯ হাজার তিনশ’ টাকা এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকরা পান ৯ হাজার সাতশ’ টাকা। এর মধ্যে কল্যাণ ফান্ডের জন্য ৫০ টাকা ও ভবিষ্যৎ তহবিলের জন্য বাধ্যতামূলক এক হাজার টাকা কেটে নেওয়া হয়। ফলে নন ট্রেইনিরা ৮ হাজার একশ’ টাকা ও ট্রেইনি শিক্ষকরা ৮ হাজার ৬৫০ টাকা প্রতি মাসে বেতন পান। এ দিয়েই তাঁদের জীবন-জীবিকা নির্বাহ করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় শিক্ষকরা চরম হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। নিজেদের এ দুঃখ-দুর্দশার কথা বলতে গিয়ে গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মাহমুদুল হাসান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘ভাবছি বিদেশ গিয়ে মানুষ যেভাবে বড় বড় ইটের বাড়ি বানাচ্ছে, বড় অফিসাররা যেভাবে জায়গাজমি রাখছেন, যেভাবে টাকার মান কমে যাচ্ছে, যেভাবে মানুষের বাড়িতে কাজের লোক কমে যাচ্ছে আর প্রাইমারি স্কুলের সহকারী শিক্ষকদের বেতন-ধাপ নিম্নে চলে যাচ্ছে, তাতে আমি মুসলিম বিধানের কথাই বলছিÑ একদিন জাকাত দেওয়ার লোক অবশেষে প্রাইমারি স্কুলের সহকারী শিক্ষকদেরকেই শনাক্ত করতে হতে পারে। একজন রিকশাওয়ালারও সারাদিনে ৮০০ থেকে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত ইনকাম করার নজির রয়েছে। কিন্তু আমরা সহকারী শিক্ষকরা সারাদিন তো স্কুলেই কাটাই। কিন্তু কত টাকা পাই? বাকি আর কি করার ক্ষমতা আর সামর্থ্য থাকে? আমরা যেন সরকারি কামলা।’ দিনাজপুর জেলার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক তৌফিকুল ইসলাম রবি বলেন, ‘আমি যখন ২০০০ সালে চাকরিতে যোগদান করি, তখন আমার বেতন স্কেল ছিল ১৬২৫ টাকা। ওই একই বছর আমার বর্তমান স্কুলের প্রধান শিক্ষকও যোগদান করেন ১৭৫০ টাকা বেতন স্কেলে। তখন প্রধান শিক্ষক এবং সহকারী শিক্ষকের বেতন স্কেলের ব্যবধান ছিল এক ধাপের। আমাদের পদমর্যাদা ছিল একই। অর্থাৎ তৃতীয় শ্রেণি। ১৪ বছর পর আজ প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে আমার সম্পর্কের ব্যবধান তৈরি না হলেও ব্যবধান তৈরি হয়েছে বেতন আর পদমর্যাদায়। ১২ বছরে আমরা একইসঙ্গে দ্বিতীয় টাইম স্কেল পাই। ব্যবধান তৈরি হলো তিন ধাপের। আমি ৫৫০০ আর আমার প্রধান শিক্ষকের ৮০০০ টাকা স্কেল। নতুন ফিক্সেশনে আমার হলো ৫৯০০ আর প্রধান শিক্ষকের ১১০০০ টাকা। এভাবে দূরত্ব তৈরি হতে থাকলে সত্যিই সহকারী শিক্ষকরা তাঁদের কর্মস্পৃহা হারিয়ে ফেলবেন।
তিনি বলেন, এমনিতেই আমরা চরম বৈষম্যের শিকার; তারপরও কিছু কিছু প্রধান শিক্ষকের বক্তব্য শুনলে কষ্ট হয়। আমরা আমাদের অধিকার আদায়ে আন্দোলন করছি, প্রধান শিক্ষকদের বিরুদ্ধাচরণ তো করছি না।’
জানা গেছে, গত বছরের শেষদিকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা বেতন বৈষম্য ও পদমর্যাদাসহ নানা দাবিতে আন্দোলনে নামেন। এসব দাবির মধ্যে সহকারী শিক্ষকদেরও দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা দিয়ে প্রধান শিক্ষকদের এক ধাপ নিচে বেতন প্রদান, সরাসরি প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ বন্ধ করে সহকারী শিক্ষক থেকে পদোন্নতি প্রদান, সারা বছর বদলি কার্যক্রম চালু রাখা, শিক্ষক নিয়োগে পোষ্য কোটা ২৫ শতাংশ করাসহ মোট ১১ দফা দাবি উল্লেখ করা হয়।
এ বিষয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির সদস্য সচিব মো. শামছুদ্দিন ভোরের পাতাকে বলেন, ১১ দফা দাবি আদায়ে কোনো সাড়া পাইনি। প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু এখনও তা বাস্তবায়ন হয়নি। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বৈষম্য দূর করতে নতুন পে-স্কেলের ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু এই পে-স্কেলের মাধ্যমে কীভাবে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকদের বৈষম্য দূর করা হবে, তার কোনো ধারণা দেওয়া হয়নি।
গত ১৯ অক্টোবর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় পরিদর্শনকালে এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, নতুন পে-কমিশন হলে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন বৈষম্যের সমাধান হবে। একইসঙ্গে তিনি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক নিয়োগে মান বজায় রাখতে আলাদা কমিশন গঠনে তাগিদ দিয়েছেন। এ সময় মন্ত্রণালয়ের সার্বিক কার্যক্রম তুলে ধরেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান। কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বাড়িয়েছে এবং নতুন পে-কমিশনের মাধ্যমে বিভিন্ন বেতন স্কেলের পার্থক্য নিরসন করবে। এছাড়া সরকারি চাকরিজীবীদের পরিবারের সদস্যসংখ্যা চারের পরিবর্তে ছয় হিসাব করে শিক্ষকদের বেতন ও অন্যান্য সুবিধা নির্ধারণ করা হবে।
উল্লেখ্য, ড. ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে নতুন পে-কমিশনের কাজ চলছে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মর্যাদা বাড়ানোর জন্য প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকদের বেতন স্কেল যথাক্রমে ১০/১১ ও ১২/১৩ গ্রেডে উন্নীতকরণের প্রস্তাব ছিল। কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও অর্থ বিভাগ প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকদের বেতন স্কেল যথাক্রমে ১১/১২ ও ১৪/১৫ গ্রেডে উন্নীত করে। এর ফলে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকদের বেতন স্কেলে ব্যবধান এক ধাপ বেড়ে যাওয়ায় এ নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে অসন্তোষ ছিল।
এর আগে গত ৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের মর্যাদা তৃতীয় শ্রেণি থেকে এক ধাপ উন্নীত করে দ্বিতীয় শ্রেণি করার ঘোষণা দেন। পাশাপাশি সহকারী শিক্ষকদেরও বেতন স্কেল বাড়ানোর ঘোষণা দেন তিনি। এরপরই প্রধান শিক্ষকদের মর্যাদা বাড়ানোর পাশাপাশি সহকারী শিক্ষকদের বেতন বাড়ানোর বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু সেটা বাস্তবায়ন হয়নি। এছাড়া প্রধান শিক্ষকদের এক ধাপ নিচে সহকারী শিক্ষকদের বেতন স্কেল রাখার দাবিটি সরকার মেনে নেয়নি বলে দাবি শিক্ষকদের।

Facebooktwitterredditpinterestlinkedinby feather
Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।