প্রাথমিকের বই ছাপার কাজ অর্ধেক মুদ্রণ হবে ভারতে

সুব্রত রায়: এবার প্রাথমিকের সাড়ে ১১ কোটি পাঠ্যবইয়ের দুই-তৃতীয়াংশ ছাপার কাজ চলে যাচ্ছে বিদেশে। এর মধ্যে আবার অর্ধেক বই ছাপার কাজ পাচ্ছে ভারত। ২০১৭ শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিকের ১১ কোটি ৫৭ লাখ বই ছাপার জন্য ৯৮টি লটে ভাগ করে দরপত্র আহবান করা হয়। ৯৮টি লটের মধ্যে ভারত ৪৮টি লটে সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েছে। এ ছাড়া চীন আট এবং দণি কোরিয়ার সাতটি প্রতিষ্ঠান সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েছে। সব মিলিয়ে ৯৮টি লটের মধ্যে ৬৩টি লটে বিদেশী প্রতিষ্ঠান সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েছে। ৩৫টি লটে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠান সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েছে।
ভারত যে ৪৮টি লটে সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েছে তার মধ্যে শুধু পিতামব্রা বুকস প্রা লি একাই ৪২টি লটে সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েছে। এ ছাড়া ভারতের অপর তিনটি প্রতিষ্ঠান ছয়টি লটে সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েছে।
তবে ভারতের পিতামব্রা বুকস ৪২টি লটে সর্বনিম্ন দরদাতা হলেও তাদের কাজ পাওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সূত্র জানিয়েছে, পিতামব্রা যে কাগজপত্র জমা দিয়েছে তার মধ্যে একটি জাল সনদ রয়েছে। পিতামব্রা ভারতে একটি নামকরা প্রতিষ্ঠান হলেও বাংলাদেশে এনসিটিবির বই ছাপার অভিজ্ঞতার যে সনদ জমা দিয়েছে তা জাল বলে জানিয়েছে সূত্র। আগের চেয়ারম্যানের বরাতে তারা এ জাল সনদ জমা দিয়েছে বলে জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে এনসিটিবি চেয়ারম্যান প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র সাহা জানান, আমি বিষয়টি শুনেছি। টেকনিক্যাল কমিটি আছে তারা সবদিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে। পিতামব্রার কাজ পাওয়া নিয়ে সংশয় বিষয়ে প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, সর্বনিম্ন দরদাতা হওয়াই কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে একমাত্র যোগ্যতা নয়। আনুষঙ্গিক সব দিক বিবেচনা করে কমিটি সিদ্ধান্ত নেবে।
তবে কেউ কেউ সংশয় প্রকাশ করে বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে এবারো গত বছরের মতো জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। তা ছাড়া ভারতের পিতামব্রা যেসব লটে সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েছে তাতে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় দরদাতার ক্ষেত্রে দামে প্রায় দ্বিগুণ ব্যবধান।
গত বছর প্রাথমিকের সাড়ে ১১ কোটি বই ছাপার পুরো কাজ পেয়েছিল বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এবার বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠান সর্বনিম্ন  দরদাতা না হওয়ার কারণ হিসেবে জানা গেছে তারা গত বছরের তুলনায় এবার অনেক বেশি দাম উল্লেখ করেছে। যেমন গত বছর প্রতি ফর্মা বই ছাপার খরচ তারা উল্লেখ করেছিল ১ টাকা ৫৫ পয়সা। এবার সে খরচ ধরা হয়েছে ২ টাকা ২৭ পয়সা।
এ ছাড়া বই ছাপার ক্ষেত্রে ভারতের প্রতিষ্ঠান ভারত এবং বাংলাদেশ উভয় সরকার কর্তৃক যেসব সুযোগসুবিধা ভোগ করে তা বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠান পায় না মর্মে অভিযোগ রয়েছে বাংলাদেশের প্রেসমালিকদের। ফলে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠান তাদের সাথে দামের প্রতিযোগিতায় টিকতে পারে না। যেমন বাংলাদেশের কাগজ রফতানি থেকে শুরু করে আনুষঙ্গিক অন্যান্য জিনিসপত্র রফতানিতে ৬১ ভাগ পর্যন্ত ট্যাক্স দিতে হয় যা ভারতের প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় না। তাদের কাগজ রফতানি করতে হয় না। ভারত থেকে যে পাঠ্যপুস্তক ছাপিয়ে আনা হয় তা আমদানিকৃত পুস্তক হিসেবে গণ্য করা হয় এবং আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান হলো এনসিটিবি। ভারত থেকে আনা বইয়ের ক্ষেত্রে এনসিটিবি ১২ ভাগ শুল্ক দেয়। ভারতীয় প্রতিষ্ঠানকে এ শুল্ক দিতে হলে তাদের বই ছাপার খরচ আরো অনেক বেশি পড়ত বলে জানান প্রেসমালিকরা। তা ছাড়া দেশীয় কোনো লোক এনসিটিবি থেকে কাজ পেলে যত টাকার কাজ পাবে তার ওপর শতকরা পাঁচ ভাগ ট্যাক্স কেটে রাখা হয়। এসব কারণে বিদেশী প্রতিষ্ঠানের সাথে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলোকে অসম প্রতিযোগিতায় পড়তে হয় প্রাইমারি বই ছাপার কাজ পেতে।
প্রেসমালিকরা অভিযোগ করেছেন, দেশীয় মুদ্রণ শিল্প সুরক্ষার জন্য এবার বাজেটে বই আমদানির ক্ষেত্রে বিদ্যমান ট্যাক্স বাড়িয়ে ২৫ ভাগ পর্যন্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এটা কার্যকর হলে ভ্যাটসহ ৫০ ভাগ পর্যন্ত কর দিতে হবে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানকে। কিন্তু এনসিটিবি তা আমলে নিচ্ছে না। এটা বাস্তবায়িত হলে দেশীয় প্রতিষ্ঠান লাভবান হতো।
দামের ব্যবধান : ৫৫ নম্বর লটে ভারতের পিতামব্রা সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে দর উল্লেখ করেছে ২ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। ভারতেরই আরেকটি প্রতিষ্ঠান কৃষ্না ট্রেডার্স ৫৫ নম্বর লটে দ্বিতীয় দরদাতা হয়েছে এবং তারা এ লটে দর উল্লেখ করেছে ৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা।
৫৪ নম্বর লটে ভারতের পিতামব্রা সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েছে। তারা দর উল্লেখ করেছে ২ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। চীনের হুনান তিয়ানওয়েন জিনহুয়া দ্বিতীয় দরদাতা হিসেবে দর উল্লেখ করেছে ৩ কোটি ৯১ লাখ টাকা। তৃতীয় দরদাতা ভারতের কৃষ্ণা দর উল্লেখ করেছে ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
৫৭ নম্বর লটে পিতামব্রা ২ কোটি ৭৪ লাখ টাকা দর উল্লেখ করেছে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে। দ্বিতীয় চীনের হুনান হিয়ানওয়েন জিনহুয়া ৩ কোটি ৭০ লাখ এবং তৃতীয় বাংলাদেশের কচুয়া প্রেস ৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা দর উল্লেখ করেছে।
এভাবে ভারতের পিতামব্রা অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে প্রায় ক্ষেত্রেই অর্ধেক দরে বই ছাপার প্রস্তাব করেছে।
গত বছর প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিকের সাড়ে ১১ কোটি বইয়ের জন্য এনসিটিবি বাজারদর যাচাই করে সম্ভাব্য দর ঠিক করে ৩৩০ কেটি টাকা। কিন্তু দেশীয় মুদ্রাকররা যে দরপত্র জমা দেয় তাতে বই ছাপার মোট খরচ উদ্ধৃত করা হয়েছে ২২১ কোটি টাকা। এনসিটিবির নির্ধারিত দরের চেয়ে এটি ১০৯ কোটি টাকা কম যা অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রশ্ন ওঠে এত কম দামে কিভাবে তারা বই ছাপার কাজ করবে। তারা মানসম্মত বই দেবে না বলে অভিযোগ উত্থাপন করা হয়।
তবে গত বছর বইয়ের মান রক্ষা সম্ভব হয়নি এ অভিযোগ স্বীকার করেছেন মুদ্রণ শিল্প নেতৃবৃন্দ। বই ছাপার কাজ যাতে দেশেই থাকে সে জন্য গত বছর দেশীয় প্রেসমালিকেরা একজোট হয়ে অবিশ্বাস্য কম দামে বইয়ের দর উল্লেখ করেন দরপত্রে। এবার অভিযোগ পাওয়া গেছে দেশীয় প্রেসমালিকেরা বই ছাপার কাজে বেশি মূল্য নির্ধারণ করেছেন।
বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি শহীদ সেরনিয়াবাত বলেন, গত বছরের বইয়ের মান নিয়ে আমরা সত্যিই লজ্জিত। বইয়ের কাজ যেই পাক আমাদের দাবি সেটা যেন নিয়ম অনুযায়ী হয় এবং বইয়ের মান যেন ঠিক থাকে।

Facebooktwitterredditpinterestlinkedinby feather
Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।