প্রধান শিক্ষক ঘেরাও, হুমকি ছাত্রছাত্রীদের

ডেস্ক | : কলকাতার দমদমের একটি স্কুল। শ্রেণিকক্ষের বেঞ্চিতে বসে আছেন প্রধান শিক্ষক, দুই সহকারী জেলা স্কুল পরিদর্শক এবং এক স্কুল পরিদর্শক তথা ওই স্কুলের প্রশাসক। তাঁদের ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়ুয়া ও অভিভাবকরা। কিছুটা তফাতে স্কুলের অন্য শিক্ষকরা।
সামনের সারিতে ছাত্রীরা। তারা কখনও টেবিল চাপড়াচ্ছে! কখনও তর্জনী তুলে প্রধান শিক্ষকের উদ্দেশে চোখা চোখা শব্দ ছুড়ে দিচ্ছে! পেছনেই ছাত্রেরা। অভিভাবকেরাও কম যান না। তাঁদের কেউ কেউ ‘জিও জিও’ বলে উৎসাহ দিচ্ছেন। মাথার ওপর হাত তুলে চলছে করতালিও।
চাপে পড়ে শেষ পর্যন্ত সাদা কাগজে মুচলেকা লিখে দিতে হল প্রধান শিক্ষককে। সেই কাগজে সই করলেন স্কুল পরিদর্শকও। আর সেই সময়ে অভিভাবকেরা কেউ কেউ ফের হাততালি দিয়ে উঠলেন।
বৃহস্পতিবার এমন দৃশ্যই চোখে পড়ল দমদমের পূর্ব সিঁথি ভারতী বিদ্যামন্দিরে। সেখানে ছিল পঞ্চম থেকে দশম, সব ক্লাসের পড়ুয়ারাই। ছিল এবারের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীরাও। তবে উঁচু ক্লাসের ছাত্রীরাই বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিচ্ছিল।
ক্লাসে বিদ্যুৎ সংযোগ, পানীয় জল, মিড-ডে মিল, ‘সবুজ সাথী’র সাইকেল, ‘শিক্ষাশ্রী’ ও ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্পের সুবিধা পাওয়ার দাবিতে সোমবার গেট আটকে শিক্ষকদের ভেতরে ঢুকতে দেয়নি ওই স্কুলের পড়ুয়ারা। বৃহস্পতিবার সে অভিযোগ খতিয়ে দেখতে জেলা পরিদর্শকের প্রতিনিধি হিসেবে তিন শিক্ষাকর্তা সেখানে যান। তাঁদের সামনে পেয়ে প্রধান শিক্ষক সমীর বিশ্বাসের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দেয় ছাত্রছাত্রীরা।
একটি ক্লাসঘরে তারা আটকে রাখে প্রধান শিক্ষক ও তিন শিক্ষাকর্তাকে। হাজির হন তাদের বাবা-মায়েরাও।
অভিভাবক ও ছাত্রছাত্রীদের দাবি ছিল, প্রধান শিক্ষককে তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা সমস্ত অভিযোগ স্বীকার করে মুচলেকা দিতে হবে। জেলা স্কুল প্রশাসনের প্রতিনিধিদেরও লিখিত আশ্বাস দিতে হবে।
এক সময়ে মুচলেকা লিখে দিতে রাজি হন প্রধান শিক্ষক। তিনি কী লিখবেন, তা তর্জনী উঁচিয়ে বলতে থাকে ছাত্রীরাই। মুচলেকায় অবিলম্বে স্কুলের বিদ্যুৎ সংযোগ ফিরিয়ে আনার কথা যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে ‘কোনও স্টুডেন্টের গায়ে হাত দেব না, কথায় কথায় হুমকিও দেব না’র মতো প্রতিশ্রুতিও।
এই মুচলেকায় জেলা স্কুল প্রশাসনের প্রতিনিধিরা সই করতে রাজি হননি। এক ছাত্রী বলে ওঠে, ‘‘আমরা যেমন ভাল, তেমন খারাপ! সই না করলে বেরোতে দেব না।’’
ঘেরাও শুরু হওয়ার সাড়ে চার ঘণ্টা পরে বিকেলে স্থানীয় তৃণমূল কাউন্সিলর জয়ন্তী সেনশর্মা ও জেলার যুব তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক রাজু সেনশর্মা স্কুলে যান। তার পরে বেরোতে পারেন জেলা স্কুল প্রশাসনের কর্তারা।
ছেলেমেয়েদের এই আচরণে উৎসাহ দিলেন কী ভাবে? এক অভিভাবকের মন্তব্য, ‘‘ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গিয়েছে। জেলা স্কুল প্রশাসনের কর্তারা আগেও এসেছিলেন। কোনও লাভ হয়নি। মুখের কথায় কী ভাবে আস্থা রাখব?’’
প্রধান শিক্ষক সমীর বিশ্বাসের অভিযোগ, ‘‘সবটাই সংগঠিত, পরিকল্পিত।’’ জেলার যুব তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক রাজু অবশ্য
বলেন, ‘‘আমার চোখে বিক্ষোভের ধরনে অন্যায় নেই। অভিভাবকদের মধ্যে ক্ষোভ ছিল। তারই চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।’’
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের শিক্ষক অভিজিৎ কুণ্ডু বলেন, ‘‘এ কাজে যাঁরা উৎসাহ দিলেন, এটা তো তাঁদের সঙ্গেও ঘটতে পারে। আজ স্কুলে হচ্ছে, কাল পাড়ায়, পরশু ঘরে হবে। নিয়ম ভাঙার এই আনন্দ নৈরাজ্যেরই নামান্তর।’’
প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ, শিক্ষাবিদ অমল মুখোপাধ্যায়ের মন্তব্য, ‘‘ছাত্রছাত্রীদের অভিযোগগুলি ন্যায্য হলেও তাদের, বিশেষ করে অভিভাবকদের এমন আচরণ ক্ষমা করা যায় না। স্কুলে স্কুলে বিক্ষোভের এই সংস্কৃতি সামাজিক অবক্ষয়েরই প্রতিফলন।’’
Facebooktwitterredditpinterestlinkedinby feather
Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।