নেপথ্যে শীর্ষস্থানীয় স্কুলশিক্ষকরা কোচিং ফাঁদে শিক্ষার্থীরা

image-32972সরকারি আইন অমান্য করে কোচিং বাণিজ্যে তৎপর হয়ে উঠেছে রাজধানীর শীর্ষস্থানীয় স্কুলের শিক্ষকর। ক্লাস পাঠদানে মনোযোগ না দিয়ে শিক্ষার্থীদের নানাভাবে বাধ্য করে বাসায় বা নিজেদের কোচিং সেন্টারে পড়াচ্ছে। শিক্ষকদের এই কোচিং সেন্টারে না পড়লে পরীক্ষায় নম্বর কমিয়ে দেয়া হচ্ছে। তাই সুনজরে আসার জন্য বাধ্য হয়েই কোচিংয়ে ব্যাচ করে স্কুল শিক্ষকদের কাছে তাদের সন্তানদের পড়াতে হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন অভিভাবকরা।

সরেজমিন অনুসন্ধানকালে অভিভাবকরা জানিয়েছেন, ব্যাচভিত্তিক পড়ানো, মডেল টেস্ট নেয়া, বড় আকারের কোচিং ইত্যাদি নানা স্টাইলে চলছে বেআইনী কোচিং। এর বিনিময়ে শিক্ষার্থীপ্রতি সর্বনিম্ন ১ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা করে নেয়া হয়। এতো টাকা নেয়া হলেও সপ্তাহে প্রতি ব্যাচ মাত্র তিনদিন পড়ান শিক্ষকেরা। রাজধানীর আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষকদের কোচিংপাড়া হিসেবে খ্যাত শাহজাহানপুর এলাকা। উত্তর শাহাজানপুরের অন্তত শতাধিক বাড়ি, দক্ষিণ শাহজাহানপুরের শিল্পী হোটেলের গলি, বেনজির বাগান, মুগদাপাড়া শাখা, বনশ্রী এলাকায়ও অনেকেই পড়িয়ে থাকেন। এলাকাবাসীর অভিযোগ, প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ব্যাচ ধরে ঝাঁকে ঝাঁকে শিক্ষার্থী পড়ানো হয়। শিক্ষার্থীদের হইচই ও হুল্লোড়ে বাসাবাড়িতে বসবাস কঠিন হয়ে পড়ে। বাড়ির মালিকেরা ফ্যামিলি ভাড়াটিয়ার চেয়ে তুলনামূলক বেশি ভাড়া পান কোচিং সেন্টারকে বাসা দিয়ে। এরমধ্যে কেবল শাহজাহানপুর এলাকায় এ ধরনের শতাধিক ভবনের সন্ধান পাওয়া গেছে। এগুলোর বেশিরভাগই পরিচালনা করছেন মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষকরা।

দেখা গেছে, প্রতিদিন ৮ থেকে ১০টি ব্যাচে কোচিং দেওয়া হচ্ছে। কোনো কোনো শিক্ষক একাই ৩০০ থেকে ৭০০ ছাত্রছাত্রী পড়ান। প্রতিটি ব্যাচ সপ্তাহে তিনদিন পড়ছে। ব্যাচ পড়াতে কয়েকটি ফ্ল্যাটে শিক্ষকদের প্রস্তুতিও রীতিমতো নজরকাড়া। উত্তর শাহজাহানপুর এলাকায় দেখা যায়, খিলগাঁও ফ্লাইওভারের শাহজাহানপুর অংশে গোড়ায় পশ্চিমপাশে ৬১০ নম্বর বাড়িতে পুণম ফার্নিচারের দোতলায় ৭/৮জন শিক্ষক কোচিং পসরা নিয়ে বসেছেন। ভেতরে গিয়ে মনে হল কোনো স্কুল সেটা। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে গিয়ে ইংরেজি ভার্সনের শিক্ষক আবদুল জলিল একটি কক্ষে টেবিল নিয়ে বসে আছেন। কয়েকশ শিক্ষার্থী এবং অভিভাবক সেখানে গিজ গিজ করছে। আবদুল জলিল প্রতিদিনের সংবাদের এই প্রতিবেদককে প্রথমে বলেন, তিনি নবম-দশম শ্রেণির কমার্সের শিক্ষক। স্কুলে কমার্সে শিক্ষার্থী নেই। তাই তিনি কোনো কোচিং করান না। পরে তার টেবিলে দেখা যায়, তৃতীয় শ্রেণির বাংলা বিষয়ের মডেল টেস্টের প্রশ্ন এবং চতুর্থ শ্রেণির ইংরেজি ভার্সনের গণিতের স্পেশাল মডেল টেস্টের পরীক্ষার সময়সূচি। ‘বার্ষিক পরীক্ষা-২০১৬’ লেখা এই সময়সূচিতে ৬ নভেম্বর থেকে ১৫ নভেম্বর কবে কোন বিষয়ে মডেল টেস্ট নেয়া হবে- সে তথ্য। নীচে লেখা আছে, এ বাবদ প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে দেড় হাজার টাকা করে দিতে হবে। তবে যারা তার কোচিংয়ের ছাত্র তাদের ৫০০ টাকা দিলেই চলবে। বি: দ্র: দিয়ে লেখা আছে—সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত যে কোনো সময়ে শিক্ষার্থীরা মডেল টেস্ট দিতে পারবে। শিক্ষক জলিল নিজেই এই সময়সূচি এই প্রতিবেদকের হাতে তুলে দিয়ে বলেন, সরকার বেতন বাড়িয়ে দিক কোচিং আর করাব না। এভাবে কোচিং করানো সম্মানজনকও নয়। ‘সরকার তো দ্বিগুণ করেছে বেতন’ এমন কথার জবাবে তিনি বলেন, এতে হয় না। যা বাড়িয়েছে তার বেশি ট্যাক্স নিচ্ছে। বাসা ভাড়াসহ বিভিন্ন খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে।

আবদুল জলিলের ভাষ্য অনুযায়ী, ওই মিনি স্কুলে তিনি একা আইডিয়াল স্কুলের নন বরং নিগার সুলতানা, আবদুস সালাম, মোতালেব, জয়নাল আবেদীন, আলী নেওয়াজ আল করিম এবং মতিঝিল মডেল স্কুল ও কলেজের শিক্ষক কবির হোসেনসহ আরও কয়েকজন পড়ান। তিনি বলেন, ওই এলাকায় কেবল আইডিয়াল স্কুলের শিক্ষকদেরই আরও কয়েকশ বাড়িতে কোচিং সেন্টার আছে।

অভিযোগ রয়েছে, রাজধানীর আইডিয়াল স্কুল ও কলেজে গত ২৫ অক্টোবর টেস্ট পরীক্ষা চলাকালে ওয়ারেসুল ইসলাম হিমেল নামে এক ছাত্রকে পিটিয়ে হাত ভেঙে দেন রসায়নের শিক্ষক ফখরুদ্দীন। আহত হিমেল এবং তার মা জেসমিন নাহারের অভিযোগ, ওই শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট না পড়ায় এভাবে কাঠের বেতন দিয়ে পেটানো হয়। হিমেল দশম শ্রেণিতে ওঠার পর থেকেই মূলত এই শিক্ষক প্রাইভেট পড়ার জন্য চাপাচাপি করছিলেন।

উত্তর শাহজাহানপুর ৪৯১/সি নম্বর বাড়িতে মিনি স্কুল খুলে বসেছেন মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক জহিরুল ইসলাম। ছোট্ট কক্ষে ৮-১০টি লো-হাই বেঞ্চ পাতা আছে। সেখানে ২০-২৫জন ছাত্রকে দেখা গেছে। অভিভাবক পরিচয়ে এই শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি বাসার পেছনে নিয়ে যান। এরপর বলেন, ‘আপনাদের দেখে মনে হচ্ছে অভিভাবক নন। অভিভাবকদের পীড়াপীড়িতে আমি অল্প কজনকে পড়াই।’

শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য সম্পর্কে অভিভাবকরা মুখ খুলতে চান না। এই স্কুলের অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রী ও কেন্দ্রীয় অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু বলেন, ‘আইডিয়ালে প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই কোচিংকে প্রশ্রয় দেয়া হয়। এর প্রমাণ হচ্ছে, গত এপ্রিলে কোচিং করানোর জন্য স্কুলে কক্ষ ভাড়া দেয়া হয়। আগস্ট পর্যন্ত তা বহাল ছিল। পরে অভিভাবকসহ বিভিন্ন মহলের চাপে কক্ষ বরাদ্দ বাতিল করা হয়। এরপর সবাই আবার আগের মত বাসা ভাড়া করে কোচিং করাচ্ছেন বলে জানান।

২০১২ সালের গত ২০ জুন ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধ নীতিমালা-২০১২’ জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সে অনুসারে কোনো শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়াতে পারবেন না। প্রতিষ্ঠান প্রধানের লিখিত অনুমতিসাপেক্ষে অবশ্য অন্য প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ ১০ শিক্ষার্থীকে পড়াতে পারবেন। কিন্তু এই নীতিমালা বর্তমানে কেতাবের বাণীতে পরিণত হয়েছে।

গত ২ নভেম্বর মনিপুর এলাকায় সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের আশপাশে শতাধিক কোচিং সেন্টার গড়ে উঠেছে। স্থানীয় এবং অভিভাবকদের অভিযোগ, এসব প্রতিষ্ঠানের কোনোটির মালিক স্কুলের শিক্ষক আবার কোনোটির মালিক স্কুলের বর্তমান বা সাবেক পরিচালনা কমিটির সদস্য। এর বাইরে শিক্ষকেরা বিভিন্ন বাসাবাড়ি ও ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে প্রাইভেট-কোচিং সেন্টার গড়ে তুলেছেন। গ্রিনভিউ হাই স্কুলের গলি স্থানীয়দের কাছে মাস্টারপাড়া হিসেবে পরিচিত। ওই গলির ৭৬৪/১ নম্বর বাড়িতে মণিপুর স্কুলের শিক্ষক সৈকত ও ফিরোজের বাসা। এই বাড়ির কেয়ারটেকার বাবলু জানান, ‘স্যারেরা আগে বাড়িতেই ব্যাচে ছাত্রছাত্রী পড়াতেন। কয়েকমাস ধরে বাসা ভাড়া নিয়ে তারা বাইরে পড়ান।’ তিনি আরো জানান, ওই গলিতে অনেক শিক্ষকের বসবাস। সকাল ১১টা এবং বিকাল ৪টার পর ছাত্রছাত্রীদের ঢল নামে গলিতে। তার কথার সূত্র ধরে ৭৬৩/৮ নম্বর বাড়িতে গিয়ে জানা যায়, কম্পিউটার শিক্ষক সোলেমান ফারসি এবং ৭৬৩/৫ ও ৭৬৩/৬ নম্বর বাড়িতে আপন, কায়েসসহ ৬জন শিক্ষক পড়ান। এরমধ্যে ৭৬৩/৫ ও ৭৬৩/৬ নম্বর বাড়ির দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় গিয়ে দুই নারী ও দুই শিশুর কাছে জানা যায়, শিক্ষকেরা বাসা ভাড়া নিয়েছেন শুধু কোচিংয়ের জন্য, বসবাস করেন অন্যত্র। তারা নামপ্রকাশ করতে রাজি হন নি। তবে ৭৬৩/৮ নম্বর বাড়িতে সোলেমান ফারসির ছেলে তালহা জানান, তার বাবা গণিত বিষয়ে কোচিং দেন। বাবা সকালে বের হন আর রাতে ফেরেন। এ কারণে তার সঙ্গে বাবার সাক্ষাত হয় না।

মণিপুর স্কুলের মূল (বালিকা) শাখার গেটের ঠিক বিপরীত পাশের বাড়ির সিঁড়িতে বসে অপেক্ষা করছিলেন কোহিনুর বেগম নামে একজন অভিভাবক। তিনি জানান, এই এলাকার বেশির ভাগ কোচিং সেন্টার কোনো না কোনো শিক্ষকের। এরমধ্যে শহীদ স্যারেরই দুটি। একটি হচ্ছে আধুনিক, আরেকটি ইনটেনসিভ। সামনে স্যার নেই। কিন্তু নেপথ্যে তিনিই। এর প্রমাণ হচ্ছে, কোচিং থেকে যত লেকচার শিট, সাজেশান দেয়া হয়, সবগুলোতেই শিক্ষকের নাম থাকে। ফয়সাল নামে আরেকজন অভিভাবক জানান, স্কুলে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত কোচিংয়ের ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা কম। এ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগই বাইরের কোচিংয়ে পড়ে। কিন্তু অষ্টম ও দশম শ্রেণিতে স্কুলে কোচিং আর নবম-দশম শ্রেণিতে স্কুলের শিক্ষকের কাছে ব্যাচে পড়তে হয়। নইলে বিভিন্ন পরীক্ষায় নম্বর কমিয়ে দেয়াসহ নানাভাবে হেনস্তা করা হয়। স্কুলের ঠিক সামনেই গ্রিন কোচিং সেন্টার নামে একটি প্রতিষ্ঠান আছে। এই প্রতিষ্ঠানের মালিক মণিপুর স্কুলের পরিচালনা কমিটির সাবেক সদস্য।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কোচিংয়ের ব্যাপারে কড়াকড়ির কারণে এভাবে শিক্ষকদের কেউ নিজের বসবাসের ফ্ল্যাট-বাড়ির দূরে আবার কেউ আত্মীয়স্বজন বা বেতনভুক্ত অন্য লোককে সামনে রেখে কোচিং সেন্টার চালাচ্ছেন। প্রতি ব্যাচে রয়েছে ২০ থেকে ৩০ জন শিক্ষার্থী। প্রতিদিন সকালে-বিকালে চার থেকে আটটি পর্যন্ত ব্যাচ পড়ানো হয়।বিকেলে শিক্ষকদের ওইসব বাসা-ফ্ল্যাটের সামনের রাস্তায়, বারান্দা ও সিঁড়িতেও শিক্ষার্থীদের ভিড় লেগে থাকে।

এ বিষয়ে মনিপুর স্কুল এ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ফরহাদ হোসেন বলেন, বাসায় ব্যাচ পড়ানো অভিযোগে কয়েকজন শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এর সঙ্গে যাদের প্রামাণ পাওয়া যাবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে তিনি জানান।

Facebooktwitterredditpinterestlinkedinby feather
Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।