দেশের যে কোনো প্রান্তে বইয়ের প্রসঙ্গ উঠলেই অবধারিতভাবে যেন রাজধানীর নীলক্ষেতের বই মার্কেট আলোচনায় চলে আসে। পাঠ্যবই থেকে শুরু করে বিশ্বসাহিত্য, কবিতা, উপন্যাস, রাজনীতি, অর্থনীতি, চাকরির বই ছাড়াও একশ’ বছরের পুরনো বইসহ নানা ধরনের তথ্যভাণ্ডারসমৃদ্ধ বই মেলে নীলক্ষেতে। সরকারি খাস জমিতে ১৯৬৬ সালে গড়ে ওঠে নীলক্ষেতের বইয়ের মার্কেট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল, বুয়েট, ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজকে কেন্দ্র করে প্রথমে এ এলাকায় শুরু হয় বই বিক্রি, যা বর্তমানে দেশের দুর্লভ বইয়ের মার্কেট হিসেবে পরিচিত।
দেশের নামকরা লেখকদের পাশাপাশি নীলক্ষেতের বইয়ের দোকানে পাওয়া যায় বিদেশি লেখকদের বই। দেশের বৃহত্তর এ বইয়ের মার্কেটে নির্ধারিত মূল্যের থেকে অর্ধেক দামে প্রায় সব ধরনের বই পাওয়া যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৪৬ শতাংশ জমিতে গড়ে উঠেছে নীলক্ষেতের বইয়ের মার্কেট, যার নাম ইসলামিয়া বইয়ের মার্কেট। এ মার্কেটে বর্তমানে বইয়ের সাড়ে চারশ’ স্থায়ী দোকান রয়েছে। এ ছাড়া আরো প্রায় একশ’র বেশি অস্থায়ী দোকান মার্কেটের চারপাশ ঘিরে রয়েছে।
ইসলামিয়া বইয়ের মার্কেট সরকারি খাস জমিতে গড়ে উঠেছে বলে ১৯৯৪ সালে এক মামলায় রায় দেন আদালত। এরপর থেকে এ জমি লিজ নেওয়ার চেষ্টা করে ইমলামিয়া মার্কেট বণিক বহুমুখী সমবায় সমিতি। এ সমিতির সৃষ্টি হয় ১৯৮৩ সালে পাঁচশ’ সদস্য নিয়ে।
ইসলামিয়া মার্কেট বণিক বহুমুখী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আলী আক্কাস জানান, সরকারি খাস জমি হিসেবে আদালত রায় দেওয়ার পর থেকে সমিতির নেতারা লিজ নেওয়ার জন্য আবেদন করেন। কিন্তু সমস্যা সৃষ্টি করেন দীনেশ রাম পাসি নামের একজন। পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দেখিয়ে এ সম্পত্তির মালিক তার পূর্ব পুরুষ বলে দাবি করেন তিনি। তবে আদালতের রায় এখনো সমিতির পক্ষে রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘নীলক্ষেত এলাকায় একাধিক মার্কেট রয়েছে। সব মার্কেট সরকারি খাস জমিতে। আর সব মার্কেটের লিজ হয়ে গেছে। এখন বাকি ইসলামিয়া মার্কেটের। সরকার থেকে আমরা লিজ নিয়ে এখানে বইয়ের বহুতল মার্কেট বানাব। সরকারি রেট অনুযায়ী ১০ লাখ ১২৫ টাকায় প্রতি শতাংশ লিজ নেব।’
বইয়ের মার্কেটের এখানে অন্য কোনো মার্কেট করার কথা শোনা যাচ্ছে— প্রসঙ্গ তুললেবে আলী আক্কাস বলেন, ‘বাপ-দাদার ব্যবসা বইয়ের। এর বাইরে অন্য কোনো ব্যবসা আমাদের জানা নেই। সরকার যদি আমাদের লিজ দেয় তাহলে এখানে বইয়ের বহুতল মার্কেট নির্মাণ করা হবে।’
‘ইসলামিয়া বইয়ের মার্কেট’ ভেঙে বহুতল ভবন নির্মাণ করার কথা জানেন না সাধারণ ক্রেতারা। পরিবর্তনের পক্ষ থেকে সাধারণ ক্রেতাদের এ বিষয়ে জানালে একাধিক ক্রেতা বলেন, পুরোনো আর নতুন বইয়ের ঘ্রাণ, টিন আর কাঠ দিয়ে তৈরি এ মার্কেটের আলাদা সৌন্দর্য। প্রয়োজনে এ মার্কেট টিন আর কাঠ দিয়ে সুন্দরভাবে নির্মাণ করা যায়। বহুতল ভবনে বইয়ের দোকানের সৌন্দর্য কমে যাবে। তখন আর নীলক্ষেতের সেই ঐতিহ্য থাকবে না। অন্য দশটা মার্কেটের মতো দেখতে লাগবে।
তবে বিক্রেতারা ও সমিতির নেতারা বলছেন, বহুতল ভবন হলে রাস্তার পাশের বই বিক্রেতারা স্থান পাবে। আরো লোকের কর্মসংস্থান হবে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘নীলক্ষেতের বইয়ের দোকান একটা পুরাতন ঐতিহ্য। দীর্ঘদিনের এ ঐতিহ্য বহুতল ভবনের হলে ভালো লাগবে না। এ ছাড়া আরও পাঁচটা ভবন হলেও রাস্তার পাশে দোকান বসবে।’ তিনি বলেন, ‘সব ঐতিহ্য কংক্রিটে মানায় না।’
ইসলামিয়া বই মার্কেটের বেশ কয়েকজন ক্রেতা বলেন, ‘বইয়ের দোকানিরা বই কেনার জন্য হাঁকডাক দিয়ে নিজের দোকানে ডাকেন, এর মাঝে একটা আলাদা ভালো লাগা রয়েছে। এখানে বহুতল ভবন হলে এ আন্তরিকতা থাকবে না। অন্য সব মার্কেটের ব্যবসায়ীদের মতো আচরণ হয়ে যাবে তখন।’