জেনে নিন কী ভাবে সন্তানকে মিথ্যে কথা বলা থেকে বিরত রাখবেন

শিশু বয়সের কল্পনা ঠিক-ভুলের বাধা মানে না। কিন্তু ছোট ছোট মিথ্যে ভবিষ্যতে জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে। জেনে নিন কী ভাবে সন্তানকে মিথ্যে কথা বলা থেকে বিরত রাখবেন

অনেক সময়ে যেখানে বড়রাই গুলিয়ে ফেলেন সত্যি-মিথ্যের ফারাক, সেখানে এক জন শিশুর পক্ষে বোঝা দুষ্কর, কোনটা সত্যি ও কোনটা মিথ্যে। সত্যি-মিথ্যের পরিধি সম্পর্কে শিশুটির সম্যক জ্ঞান না থাকায়, তাকে মিথ্যে বলা থেকে বিরত রাখার কাজটা আরও কঠিন হয়ে যায়। তাই একদম শিশু বয়স থেকেই এ বিষয়ে সাবধান হতে হবে। রাশ আলগা করলে কিন্তু পরবর্তী কালে জটিল সমস্যা দেখা দিতে পারে।


মিথ্যের নানা র‌ং

শিশুমন অনেক সময়েই কল্পনার জগৎ থেকে নানা রকম ধারণা করে বসে। সেটা যে আসলে মিথ্যে, সেই বোধও থাকে না। মিথ্যেরও ধরন আছে। হোয়াইট লাইজ়, রেড লাইজ়। কল্পনাপ্রবণ মন থেকে ছোটরা অনেক কিছুই বলে। সেই বানানো কথাগুলোকে বিশেষজ্ঞরা ‘সাদা মিথ্যে’ বলেন। এগুলো কিন্তু আদতে খুব একটা ক্ষতিকর নয়। ধরুন আপনার সন্তান স্কুল থেকে ফিরে বলল, সে রাস্তায় একটা পরি দেখেছে। কিংবা তার বন্ধু চকলেটের তৈরি বাড়িতে থাকে। এগুলো সে তার কল্পনার জগৎ থেকে ধার করেছে। সাধারণত ছ’-সাত বছর পর্যন্তই বাচ্চারা এ ধরনের কথাবার্তা বলে থাকে। পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষ বলছেন, ‘‘যদি দেখেন আপনার সন্তান এই রকম কিছু বলছে, তা হলে তাকে বকবেন না। উল্টে বলুন, ‘বাহ, এই গল্পটা তো বেশ ভাল।’ তাতে শিশুটির মনে হবে এটা গল্প। সে এই ধরনের কিছু বললে আপনি সেটাকে গল্পকথার মোড়ক দেওয়ার চেষ্টা করুন। এতে শিশুটি বুঝবে, এগুলো বাস্তব নয়।’’

কোনটা বাস্তব আর কোনটা কল্পনা, শিশুদের সেটা বুঝতেই সময় লেগে যায়। সন্তানের কল্পনাপ্রবণ মনকে অন্য খাতে বইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করুন। তাকে বলুন, ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে ওই কথাগুলোই বলতে কিংবা লিখে ফেলতে। তার পরে বলুন, এই গল্পটা আর একটু এগিয়ে নিয়ে যেতে। এতে শিশুটির সৃজনশীল মন উৎসাহ পাবে।

ভয় থেকেই মিথ্যের জন্ম

বাবা-মা বকবে বা মারবে, এটা সন্তানের কাছে বিরাট ভয়ের জায়গা। তাই সে কোনও ভুল করে ফেললে চাপা দেওয়ার চেষ্টায় মিথ্যে কথা বলে। ছোটখাটো বিষয়ে সন্তানকে শাসন করার বদলে বোঝানোর চেষ্টা করুন। বিশেষজ্ঞরা সন্তানের গায়ে হাত তোলার একেবারেই বিরুদ্ধে। তবে শাসনের প্রয়োজন অবশ্যই আছে। কোন বিষয়ে কতটা শাসন করবেন, সেই পরিমিতি বোধ থাকাটাও জরুরি। সন্তান ভুল করলে তা স্বীকার করার সাহস জোগান। আপনার বকুনির ভয়েই হয়তো সে মিথ্যে বলছে। টিফিন না খাওয়া বা পেনসিল বক্স হারিয়ে ফেলার মতো ছোটখাটো ঘটনায় অতিরিক্ত বকাবকি করবেন না। বুঝিয়ে কাজ হাসিল করুন। ছোট থেকেই শিশুকে নিজের জিনিসের প্রতি যত্ন নিতে শেখান। এতে সে চট করে কিছু হারিয়ে ফেলবে না। আর হারালেও তার নিজের মন খারাপ হবে এবং পরের বার অতিরিক্ত খেয়াল রাখবে। পরীক্ষায় কম নম্বর পেলে বাড়িতে না বলা, খাতা না দেখানো ইত্যাদি প্রবণতা আসে ভয় থেকেই। এগুলো সবই ‘রেড লাইজ়’-এর অন্তর্গত। সন্তানকে বোঝান, সে যদি কোনও ভুল করে, আপনি তাকে তা শোধরাতে সাহায্য করবেন।

মিথ্যে যখন ক্ষতি করে

বাচ্চারা অনেক সময়ে ইচ্ছাকৃত ভাবে মিথ্যে বলে কাউকে বিপদে ফেলার জন্য। সেটা বন্ধু কিংবা বাবা-মা যে কেউ হতে পারে। এই সমস্যাটা জটিল। টিনএজারদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি দেখা যায়। পায়েল ঘোষের পরামর্শ, ‘‘কোনও বন্ধুর প্রতি আক্রোশ থেকে মিথ্যে বলে তাকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করে অনেকে। অভিভাবকের উপরেও রাগ জন্মাতে পারে। এ ক্ষেত্রে কাউন্সেলিং দরকার। কেন সে বন্ধুর ক্ষতি চাইছে, তা খতিয়ে দেখতে হবে। বাবা-মায়ের উপরে রাগেরও নিশ্চয়ই কারণ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে অভিভাবকদেরও কাউন্সেলিং প্রয়োজন।’’ সন্তানের মিথ্যেয় রাশ না টানলে, টিনএজের গণ্ডি পেরোনোর পরেও তার মধ্যে এই প্রবণতা দেখা যাবে। প্যাথোলজিক্যাল লায়িং বেশ জটিল সমস্যা।

গলদ অভিভাবকত্বেও

আমাদের পেরেন্টিং স্ট্রাকচারেও অনেক গলদ লুকিয়ে। সেই ফাঁক দিয়ে বহু সমস্যা সন্তানের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। অনেক শিশুই নিত্য দিন কিছু না কিছু হারিয়ে আসে। এ ক্ষেত্রে তখনই তাকে জিনিসটি কিনে দেবেন না। বস্তুটির অভাববোধ তাকে যত্ন করা শেখাবে। সন্তান যাতে বাবা-মায়ের কাছে খোলাখুলি সব কথা বলতে পারে, সে ব্যবস্থাও আপনাকেই করতে হবে। এর জন্য সন্তানকে সময় দেওয়াটা জরুরি। শিশু যেন অ্যাগ্রেসিভ ভিডিয়ো না দেখে বা গেম না খেলে। এ জিনিসগুলো অজান্তেই শিশু মনের উপরে ছাপ ফেলে।

স্বীকৃতি পাওয়ার জন্যেও ছোটরা মিথ্যে বলে। হয়তো একটি ছবি তাঁর বন্ধু এঁকেছে, কিন্তু আপনার সন্তানের দাবি, সেটা তার আঁকা। ওকে বলুন, সত্যিটা আপনি জানেন। তাতে স্বীকার না করলে একটা ছবি এঁকে দেখাতে বলুন। অনেক সময়ে শিশুরা জোর গলায় কান্নাকাটি করে নিজেদের মিথ্যেকে সত্যি বলে প্রমাণ করতে চায়। এ সব ক্ষেত্রে আপনাকে কড়া হতে হবে। সেই মুহূর্তে হয়তো বকুনি দিলেন না, কিন্তু পরে তাকে আলাদা করে বলুন, আপনি সত্যিটা জানেন আর তার এই আচরণে কষ্ট পেয়েছেন।

সন্তানকে মিথ্যে বলা থেকে বিরত রাখতে আপনাকে ইমোশনালি বিষয়টা সামলাতে হবে। বোঝানোর চেষ্টা করুন, ও মিথ্যে বললেন আপনি আহত হচ্ছেন, কষ্ট পাচ্ছেন।

Facebooktwitterredditpinterestlinkedinby feather
Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।