বর্তমান প্রশাসনের দায়িত্ব গ্রহণের চার বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে আগামী বছরের ২০ মার্চ। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য নতুন উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষকে পরবর্তী সময়ের জন্য দায়িত্ব দেবেন। সেই প্রশাসনে দায়িত্ব পেতে এরই মধ্যে দৌঁড়ঝাপ শুরু করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক। শিক্ষা ও গবেষণার মান, নেতৃত্বদানের ক্ষমতা এবং দলীয় যোগ্যতায় যারা বেশি এগিয়ে থাকবেন সর্বশেষ হয়তো তিনিই পাবেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের পদটি।
এর বাইরেও একাধিক শিক্ষক ওই পদগুলোতে দায়িত্ব পেতে পারেন বলেও ধারণা সূত্রগুলোর।
জানা গেছে, এরই মধ্যে বিভিন্ন বিভাগের অন্তত ৯ জন অধ্যাপক উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ পদে পরবর্তী প্রশাসনে দায়িত্ব পেতে বিভিন্ন মহলের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখছেন। এই অধ্যাপকরা এর আগেও বিশ্ববিদ্যালয়ে একাধিক পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। সাবেক একজন উপাচার্যও নতুন করে আবারও সেই পদটি নিতে চেষ্টা চালাচ্ছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক, কর্মকর্তা ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান প্রশাসন দায়িত্ব নেয় ২০১২ সালের ২০ মার্চ। তাদের মেয়াদ শেষ হবে আগামী বছরের ২০ মার্চ। এরপর পরবর্তী চার বছরের জন্য পুনরায় বর্তমান উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষকে দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে। কেননা অনেকেই মনে করছেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা, গবেষণাসহ নানা বিষয়ের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে এই প্রশাসন খুবই সফলতা দেখিয়েছে। এই প্রশাসন দায়িত্ব নেওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক থেকে শুরু করে সব নিয়োগে অনেকাংশে স্বচ্ছতা নিয়ে এসেছে।
বর্তমান প্রশাসনের বাইরে উপাচার্য বা উপ-উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রথম উঠে আসছে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সভাপতি মো. আবুল কাশেমের নাম। তিনি ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক হলেও বর্তমানে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। নতুন বিভাগে শিক্ষক ও কর্মকর্তা কম থাকলেও তিনি একদিনের জন্য শিক্ষার্থীদের সেশনজট পড়তে দেননি। নতুন বিভাগে শিক্ষা উপকরণের স্বল্পতা হলেও তিনি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সেই সমস্যা সমাধানে কাজ করছেন।
পরবর্তী প্রশাসনে দায়িত্ব পেতে বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র উপদেষ্টা অধ্যাপক সাদেকুল আরেফিন। তিনি বর্তমানে সমাজকর্ম বিভাগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এই প্রশাসনের প্রথম তিন বছর ছাত্র উপদেষ্টা হিসেবে তিনি সফলভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও তিনি দীর্ঘদিন ধরেই যুক্ত রয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক রকীব আহমেদ প্রশানের সর্বোচ্চ পদটি পেতে অনেকের সঙ্গেই যোগাযোগ রাখছেন। তিনি বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তবে বিভাগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় হেকেপ প্রজেক্ট শেষ হলে তিনি কয়েক লাখ টাকার হিসেব দিতে পারেননি বলে অভিযোগ আছে।
সাবেক উপাচার্য (২০০৯-১২) এম আবদুস সোবহান দৌঁড়ঝাপ করছেন নতুন করে আবারও সেই পদটি নিতে। তিনি উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীসহ বিভিন্ন পদে বিজ্ঞাপিত পদের বিপরীতে একাধিক নিয়োগ দিয়েছিলেন। নিয়োগে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগে এই উপাচার্যকে আদালতের কাঠগড়াতেও দাঁড়াতে হয়েছিল। শুধু তাই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের রাকসু, টিএসসিসিসহ বিভিন্ন স্থায়ী তহবিলের কোটি কোটি টাকা শেষ করেছিলেন আবদুস সোবহান। বর্তমান প্রশাসন দায়িত্ব নেওয়ার পর ওই তহবিলের অর্থ পরিশোধ করেন। দায়িত্ব শেষ করে উপাচার্যের বাসভবন থেকে চলে যাওয়ার সময় সোবহান ওই বাসভবনের অনেক আসবাবপত্র নিয়ে যান। এ ঘটনায় পরবর্তীকালে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল।
ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মুশফিক আহমেদও পরবর্তী প্রশাসনে দায়িত্ব পেতে ‘মরিয়া’ হয়ে উঠেছেন। বর্তমান প্রশাসনে তিনি ‘ইনস্টিটিউশনাল কোয়ালিটি এসুরেন্স’ সেলের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগেও তিনি ও তার স্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাহবুবা কানিজ কেয়া এই প্রশাসন থেকে নানা রকম সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। তার স্ত্রী মনোবিজ্ঞানের শিক্ষক হয়েও রাকসুর কোষাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। তাদের একাধিক পদে দায়িত্বসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থী শিক্ষকরা ক্ষুদ্ধ।
প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি আনন্দ কুমার সাহা চেষ্টা করছেন পরবর্তী প্রশাসনে আসতে। এই অধ্যাপক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি থাকা অবস্থায় আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিতে কাজ করেছেন বলে অভিযোগ আছে। তবে তিনি বিভেদ সৃষ্টির বিষয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তিনি পরিবর্তন ডটকমকে ফোন করে বলেন, আমি ২০১৫ সালে শিক্ষক সমিতির নির্বাচিত সভাপতি ছিলাম। তার আগে ২০১০ সালে সাধারণ সম্পাদক ছিলাম এবং ১৯৯৪ সালে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। এছাড়া প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজ নামক সংগঠনের স্টিয়ারিং কমিটির নির্বাচিত আহ্ববায়ক ছিলাম ২০১১ থেকে ১৪ পর্যন্ত। এই সংগঠনের হয়ে পাঁচবার নির্বাচন করেছি। অনেকে সময় অনুপস্থিত থেকেও সর্বোচ্চ ভোটে নির্বাচিত হয়েছি। আমি বিভেদ নয়, দলের ইউনিফিকেশনের ব্যাপারেই বরাবর কাজ করেছি। আমার অবদানের কথা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাই জানেন। ব্যক্তি বিদ্বেষের কারণে আমার বিরুদ্ধে দলে বিভেদ সৃষ্টির অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।
ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার চেষ্টা করছেন দায়িত্ব পেতে। এর আগে তিনি গত প্রশাসনের সময়ে (২০০৯-১৩) ছাত্র উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। ওই প্রশাসনে নিয়ম বর্হিভূতভাবে নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। এই শিক্ষকের স্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক তানজিমা ইয়াসমিন ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেস (আইবিএসসি)-এর পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে হেকেপ প্রজেক্টে কয়েক লাখ টাকার হিসেব দিতে পারেননি। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটিও গঠিত হয়েছে।
ফলিত-রসায়ন ও রসায়ন প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. রোস্তম আলী ও লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক এবং শিক্ষক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রণব কুমার পাণ্ডে আগামী প্রশাসনে দায়িত্ব পেতে বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করছেন।
তবে শিক্ষকরা বলছেন, অনেকেই যোগাযোগ রক্ষা করলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য নিয়োগ দেবেন পরবর্তী প্রশাসনকে। তাই দেখার বিষয়, পরবর্তীতে কারা গুরুত্বপূর্ণ চেয়ারগুলোতে বসছেন। তা এখন শুধু সময়ের অপেক্ষায়।