উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করলে যে ফল হয়

যশোর জেনারেল হাসপাতালের ২৫০টি শয্যার একটিতে শুয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন মো. তুহিন ইসলাম। ২৮ বছর বয়সী এই যুবকের হাত-পা থেঁতলে দিয়েছে বখাটেরা। তাই এই যন্ত্রণা। তুহিনের অপরাধ ছিল তিনি তাঁর বোনকে উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। আর এরই জেরে চার বখাটে হাতুড়ি ও রড দিয়ে তাঁকে পেটায়। থেঁতলে দেয় তাঁর হাত ও পা।
গত রোববার প্রথম আলোয় তুহিনের ওপর বখাটেদের হামলার খবরটি প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, এলাকার জুয়েলসহ কয়েকজন বখাটে তুহিনের বোনকে উত্ত্যক্ত করত। বখাটেদের ভয়ে মেয়েটা ঘরের বাইরে যেতে পারত না। কয়েক দিন আগে এক রাতে তুহিনদের ঘরে ঢুকে পড়ে ওই চার বখাটে। তখন তাদের মেরে বের করে দেয় তুহিন। এরই জের ধরে তারা তুহিনের ওপর এমন হামলা চালায়।
এটুকু পড়ে আমরা কী বুঝতে পারলাম? আমরা বুঝতে পারলাম যে এ দেশে বখাটেরা যা খুশি তা করতে পারে। তারা মেয়েদের উত্ত্যক্ত করতে পারে। উত্ত্যক্ত করার জন্য চাইলে মেয়েদের বাড়িতে ঢুকে যেতে পারে। আর এ জন্য যদি কেউ কোনো প্রতিবাদ করে, তাহলে তাকে পেটাতে এমনকি খুনও করতে পারে। কী অবাধ স্বাধীনতা বখাটেদের! এ ঘটনা থেকে আমাদের শিক্ষা হচ্ছে, বখাটেরা যা-ই করুক না কেন, প্রতিবাদ করা যাবে না। প্রতিবাদ করলেই সর্বনাশ। এ রকম থেঁতলানো হাত-পা নিয়ে বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে।
দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কতখানি অবনতি হয়েছে আর বিচারহীনতার সংস্কৃতি কতটা বিস্তৃতি লাভ করেছে, এই ঘটনায় তার প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে এ ধরনের ঘটনা তো এই প্রথম নয়। অতীতেও অনেক ঘটেছে। এই তো গত অক্টোবর মাসের ঘটনা। দুই মেয়েকে উত্ত্যক্ত করার বিচার চাইতে গিয়ে নৃশংস হামলার শিকার হন ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের নলভাঙা গ্রামের শাহনুর বিশ্বাস। বখাটেরা তাঁর ডান পায়ে গুলি করে। এরপর শাবল দিয়ে বাম পায়ের গোড়ালি থেকে মাংস তুলে নেয়। পায়ের অবস্থা এতটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে চিকিৎসকেরা তাঁর দুই পা-ই কেটে ফেলতে বাধ্য হন। বিভিন্ন পত্রিকার খবর অনুযায়ী, শাহনুরের ওপর হামলার সময় মাহাবুর নামের এক ব্যক্তি পাশে দাঁড়িয়ে বলছিলেন, ‘খুন করি ফেলা, মামলা-মোকদ্দমা কিচ্ছু হবি না।’ কতটা আত্মবিশ্বাসী তিনি! কেননা তিনি ভালো করেই জানেন, এসব ঘটনার কোনো বিচার হয় না, কারও কোনো শাস্তি হয় না। অতএব অসুবিধা কী, কাউকে পেটালে, কাউকে পঙ্গু করে দিলে বা খুন করলে। না, কোনোই অসুবিধা নেই।
আইনি সহায়তা সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি ২০১০ থেকে এ বছরের জুন পর্যন্ত দেশে উত্ত্যক্তের ঘটনা ঘটেছে প্রায় তিন হাজার। উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় খুন হয়েছেন ৯৪ জন। তাঁদের মধ্যে উত্ত্যক্তের শিকার মেয়েদের স্বজনেরাও আছেন।
বাংলাদেশের মতো একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইনশৃঙ্খলার কোনো বালাই নেই‍, এটা ভাবা যায় না, মেনে নেওয়া যায় না। একের পর এক মেয়েকে উত্ত্যক্ত করা হচ্ছে, অথচ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিষ্ক্রিয়। যেন তাদের কিছু করার নেই। অথচ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এ রকম নিষ্ক্রিয় থাকার কোনো সুযোগ নেই। তাদের অবশ্যই সক্রিয় হতে হবে। তাদের সক্রিয় করার দায়িত্ব সরকারের। দরকার হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ঢেলে সাজাতে হবে। এ ছাড়া উত্ত্যক্তকারীদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে। অন্যথায় মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা চলতেই থাকবে। আর এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে হতাহত হবে আরও অনেকেই।

Facebooktwitterredditpinterestlinkedinby feather
Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।