হিন্দু হোস্টেলর অবস্থা খুবই করুণ আনন্দ মোহন কলেজে

anondo mohonময়মনসিংহ:: ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজ, ১০০ বছর পেরিয়েছে তা-ও আট বছর আগে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে শিক্ষার পরিসর, তারচেয়েও দ্রুত বেড়েছে শিক্ষার্থীর সংখ্যা। কিন্তু সুযোগ-সুবিধা বাড়েনি সেভাবে। কলেজের অধ্যক্ষই স্বীকার করলেন আবাসন ও যানবাহন-সংকটের কথা।
কিন্তু সরেজমিনে দেখা গেছে অনেক ক্লাসই হয় না। এর জন্য শিক্ষার্থী ও শিক্ষক দুই পক্ষের অনীহা দায়ী। আর বছরজুড়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা ক্লাস হওয়ার সুযোগ আরও কমিয়ে দিয়েছে। কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী এবং কলেজ প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত অন্তত ২০ জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ক্লাস হয় একেবারেই কম। স্নাতকে বছরে বড়জোর সাড়ে তিন মাস ক্লাস হয়। তাই সিলেবাস শেষ করতে পারেন না শিক্ষার্থীরা। বাধ্য হয়ে প্রাইভেট পড়েন। আলাদা ভবনে তুলনামূলকভাবে উচ্চমাধ্যমিকে ক্লাস বেশি হলেও এইচএসসি পরীক্ষার ফল খারাপ হচ্ছে। এ ছাড়া আবাসন ও যানবাহনের সংকট, ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীর তুলনায় ছোট শ্রেণিকক্ষ, শিক্ষার্থীর তুলনায় শিক্ষক কম থাকাসহ আরও কিছু সমস্যায় ভুগছে কলেজটি।
কলেজের অধ্যক্ষ মো. জাকির হোসেন বললেন, আবাসন ও যানবাহনের সংকটই এই কলেজের বড় সমস্যা। তবে নতুন দুটি ছাত্রীনিবাস হচ্ছে। এ ছাড়া শিক্ষকের পদ বাড়াতে হবে। আর শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বাড়ানোর চেষ্টা চলছে।
১০ একর জায়গার ওপর ময়মনসিংহ শহরে শতবর্ষী সরকারি এই কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯০৮ সালে। এখন উচ্চমাধ্যমিক ছাড়াও ২০টি বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) ও ১৮টি বিষয়ে স্নাতকোত্তর স্তরে পড়ানো হয়। প্রায় ৩২ হাজার শিক্ষার্থী। শিক্ষকের পদ ২০৭টি। তবে সংযুক্তি (অন্যত্র পদায়ন হলেও অস্থায়ীভাবে এই কলেজে) মিলিয়ে শিক্ষক আছেন ২১৬ জন। এ তথ্য গত ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত। প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত একজন শিক্ষক বললেন, সৃষ্ট পদ অনুযায়ী সংকট না থাকলেও শিক্ষার্থী বৃদ্ধি পেয়ে যত হয়েছে, সেই তুলনায় শিক্ষকের পদ কম। এখন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত ১: ১৪৮। অথচ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত ১: ২০ (সূত্র: ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদন)। দুই ধরনের প্রতিষ্ঠানেই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পড়ানো হয়।
প্রশাসনিক কাজে যুক্ত একজন শিক্ষক বললেন, ৭০টির মতো শ্রেণিকক্ষ থাকায় সাদা চোখে শ্রেণিকক্ষের সমস্যা মনে হবে না। কিন্তু বাস্তবে সমস্যা হচ্ছে। কারণ বর্তমানে সামাজিক বিজ্ঞান ও মানবিকের প্রতিটি বিষয়েই প্রতিবছর স্নাতকে সামান্য কমবেশি ২৫০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছেন। প্রিলিমিনারি থাকায় স্নাতকোত্তরে ভর্তি হন আরও বেশি। কিন্তু এত শিক্ষার্থী একসঙ্গে বসিয়ে পড়ানোর মতো শ্রেণিকক্ষ নেই। সবাই ক্লাসে উপস্থিত থাকলে একসঙ্গে পড়ানো সম্ভব নয়।
ক্লাসে কম উপস্থিতি: গত ২৭ নভেম্বর কলেজের সমাজকর্মের একটি শ্রেণিকক্ষের বারান্দা থেকে দেখা গেল বড়জোর ১০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে ক্লাস করাচ্ছেন একজন শিক্ষক। বেলা ১টা ১০ মিনিটের দিকে ইংরেজি বিভাগের একটি শ্রেণিকক্ষে গিয়ে দেখা যায়, সাতজন শিক্ষার্থী নিয়ে আরেকজন শিক্ষক ক্লাস নিচ্ছেন। অথচ এ দুই বিভাগেই স্নাতকে প্রতিবছর প্রায় আড়াই শ শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছেন।
কলেজের দুজন শিক্ষক বললেন, স্নাতকে তৃতীয় বর্ষ পর্যন্ত ভালোই উপস্থিত থাকে। কিন্তু এরপর থেকে উপস্থিতি ধীরে ধীরে কমতে থাকে। ওপরের শ্রেণিতে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীরা নানাভাবে রোজগার ও চাকরির পরীক্ষার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। পরীক্ষার জন্য ক্লাসে ৭৫ শতাংশ উপস্থিতির বাধ্যবাধকতাও মানা সম্ভব হয় না। ক্লাস না হওয়ার ক্ষেত্রে কিছু শিক্ষকেরও অবহেলা আছে বলে জানালেন প্রশাসনিক কাজে যুক্ত এক শিক্ষক।
কয়েকজন ছাত্র ও শিক্ষক বললেন, বর্তমানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বছরে প্রায় ছয় মাস পরীক্ষা থাকে। এ ছাড়া এইচএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র পড়ে। থাকে বিভিন্ন ধরনের ছুটি। ফলে বছরে সাড়ে তিন মাসের বেশি ক্লাস নেওয়া সম্ভব হয় না। এই সময়ে সিলেবাসও শেষ হয় না। ঘাটতি মেটাতে স্নাতক-স্নাতকোত্তর স্তরের শিক্ষার্থীরাও প্রাইভেট পড়েন। গণিতের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র ঝোটন কুমার সাহা বললেন, তিনি দুটি কোর্স প্রাইভেটে পড়েছেন। কোর্স ফি ১ হাজার ৫০০ টাকা।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অমান্য করে কলেজের কিছু শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেটে পড়ান। উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র হুমায়ুন কবীর বলল, সে সকাল-বিকেল মিলিয়ে কলেজের তিন শিক্ষকের কাছে পড়ে। প্রতি মাসে ৮০০ টাকা দিতে হয়।
বন্ধের পর উচ্চমাধ্যমিক চালু হলেও ফল প্রত্যাশিত না: ঐতিহ্যবাহী কলেজটি একসময় উচ্চমাধ্যমিকের জন্য বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের সেরা কলেজগুলোর একটি ছিল। কিন্তু স্নাতক-স্নাতকোত্তরকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে ১৯৯৫ সালে এখানে উচ্চমাধ্যমিক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। নানা চড়াই-উতরাই শেষে ২০০৮ সালে আবার চালু হলেও এইচএসসিতে ফল প্রত্যাশিত হচ্ছে না। চলতি বছর এইচএসসিতে ৮৯২ জন পরীক্ষা দিলেও ১৭৮ জন পাস করতে পারেননি। বিজ্ঞান শাখার ফল তুলনামূলকভাবে ভালো হলেও মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষায় খারাপ। এবার জিপিএ-৫ পাওয়া ৩০৫ জনের মধ্যে ৩০১ জনই বিজ্ঞানের। বাকি চারজন ব্যবসায় শিক্ষার। মানবিকে একজনও জিপিএ-৫ পাননি।
কলেজের উপাধ্যক্ষ গাজী হাসান কামাল  বলেন, কিছু সমস্যার কারণে এইচএসসিতে ফল খারাপ হয়েছে এটা ঠিক। তবে এখন পৃথক তদারক কমিটি করে উচ্চমাধ্যমিকে বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে। তাঁরা আশা করছেন আগামী বছর থেকে এর ইতিবাচক ফল পাবেন।
আবাসন ও যানবাহনের সংকট: মোট ৩২ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে ৫৬ শতাংশ ছাত্র ও ৪৪ শতাংশ ছাত্রী। বর্তমানে ছাত্রদের জন্য তিনটি ছাত্রাবাসে (বিভিন্ন নামে সাতটি ভবন) বড়জোর ৯০০ ছাত্র থাকতে পারে। আর ছাত্রীদের জন্য থাকা দুটি ছাত্রীনিবাসে ২৫০ আসন থাকলেও থাকেন প্রায় ৩০০ জন। আবাসন-সংকটের কারণে অধিকাংশ শিক্ষার্থীই কলেজের আশপাশের এলাকায় মেস করে থাকেন। ফলে খরচও বেশি। ইংরেজির ছাত্রী ফাহমিদা রহমান মেসে থাকেন। এ জন্য শুধু মেসের ভাড়া দিতে হয় ১ হাজার ৫০০ টাকা।
ছাত্রাবাসগুলোর অবস্থা জরাজীর্ণ।

হিন্দু হোস্টেল নামে পরিচিত সুকান্ত ভট্টাচার্য ছাত্রাবাসের অবস্থা খুবই করুণ। প্রশাসনিক কাজে জড়িত কলেজের একজন শিক্ষক বললেন, একতলার এই হোস্টেলটি কয়েকবার পরিত্যক্ত ঘোষণা করলেও ছাত্ররা ঝুঁকি নিয়ে থাকেন। তরুণ ছাত্রাবাস ভবন, কবি জসীমউদ্দীন ছাত্রাবাসও জরাজীর্ণ। উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসিক সুবিধা নেই।
কলেজে শিক্ষার্থীদের অনেকে ত্রিশাল, মুক্তাগাছা, ফুলবাড়িয়া, গৌরীপুরসহ আশপাশের এলাকা থেকে আসে। কিন্তু কলেজের বাস মাত্র একটি। তা-ও ২০ বছর আগের। কয়েকজন ছাত্র ও শিক্ষক বললেন, আরও কয়েকটি বাস হলে ওই সব এলাকার শিক্ষার্থীরা সহজেই বাড়ি থেকে এসেই ক্লাস করতে পারত।

Facebooktwitterredditpinterestlinkedinby feather
Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।