স্কুল পর্যায়ে ছাত্র রাজনীতির সিদ্ধান্তে সমালোচনার ঝড়

মাধ্যমিক স্কুল পর্যায়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কমিটি গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। এ ব্যাপারে চিঠিও ইস্যু করা হয়েছে সংগঠনের পক্ষ থেকে। সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের স্বাক্ষর করা ওই চিঠিতে প্রত্যেক মাধ্যমিক স্কুলে কমিটি গঠন করতে সব সাংগঠনিক ইউনিটকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সর্বত্র আলোচনা-সমালোচনা ও বিতর্কের ঝড় বয়ে যাচ্ছে। অভিভাবক, শিক্ষকসহ সচেতন মহল অত্যন্ত উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। অনেকেই একে জাতির জন্য অশনি সংকেত বলেও আখ্যায়িত করেছেন। অধিকাংশ মতামতই কোমলমতী শিক্ষার্থীদের যেন ছাত্র রাজনীতি ছুঁতে না পারে।
বিশেষ করে ছাত্র রাজনীতির নামে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অভ্যন্তরীণ কোন্দল, প্রতিপক্ষের ওপর হামলা, চাঁদাবাজি, আধিপত্যের সংঘর্ষ, গোলাগুলি, টেন্ডারবাজী, দখল বাণিজ্য, মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, হলের সিট নিয়ন্ত্রণসহ ছাত্রনেতাদের নানা অপকর্মে দেশের মানুষ অতীষ্ঠ। এক হিসাবে দেখা যায়, এসব ঘটনায় শুধু ছাত্রলীগেরই গত ৮ বছরে প্রায় ১৩০জন নেতাকর্মী প্রাণ হারিয়েছে। এছাড়া পুরান ঢাকায় প্রকাশ্যে ছাত্র নেতাদের হাতে দর্জি বিশ্বজিত হত্যাকান্ডের লোমহর্ষক দৃশ্য দেশের মানুষ দেখেছে। বরিশালে কলেজের অধ্যক্ষকে চ্যাংদোলা করে পানিতে ফেলে দেয়া, রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গায়ে এসিড নিক্ষেপ, জাহাঙ্গীরনগরে ছাত্রী ধর্ষণে সেঞ্চুরি করা, সিলেটের এমসি কলেজের হোস্টেলে অগ্নিসংযোগ, শরিয়তপুরসহ সম্প্রতি কয়েকটি এলাকায় ছাত্রলীগের নেতার নারী ধর্ষণ এবং ধর্ষণের দৃশ্য ধারণ করে ভিডিও প্রচার কাহিনীসহ অসংখ্য ন্যাক্কারজনক ঘটনার সঙ্গে ছাত্রলীগের নেতাদের নাম জড়িয়েছে। ঐতিহ্যবাহী সংগঠনটির নেতাদের এসব কর্মকা-ে ত্যাক্ত-বিরক্ত হয়ে সংগঠনের অভিভাবক পদ থেকে পদত্যাগ পর্যন্ত করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সম্প্রতি কয়েকটি বক্তব্যে প্রকাশ পায় ছাত্রলীগের কর্মকা-ে মূল সংগঠনের নেতারা কত ত্যাক্ত-বিরক্ত। আর এরই মধ্যে স্কুল পর্যায়ে ছাত্ররাজনীতি ঢোকানো হচ্ছে কোন্ উদ্দেশ্যে- এ নিয়ে প্রশ্ন রেখেছেন সচেতন মানুষ।
একজন মন্তব্য করেছেন, “এরপর বাচ্চা ছেলেরা গ্রুপিং নিয়ে সামান্য বিষয়েই মারামারি করবে! অবুঝ শিশু-কিশোররা মাথা গরম করে অঘটন ঘটাবে! প্রাণহানির ঘটনাও ঘটবে! আগামীতে অন্যান্য দলও কমিটি করবে। দলাদলি থেকে মারামারি হবে নিত্যদিনের ঘটনা। না, দয়া করে বাচ্চাদের প্রতিহিংসার দিকে ঠেলে দেবেন না।”
তাহসিনুর রহিম নামে একজন লিখেছেন, “রাজনীতিকে পারলে ডেলিভারি রুম পর্যন্ত নিয়ে যান, বাচ্চা জন্মের সাথে সাথেই রাজনৈতিক দীক্ষা দিয়ে দিবেন।”
অভিভাবক ও সাংবাদিক নাজনীন মুন্নী শঙ্কার কথাগুলো জানিয়ে তার পোস্টে লিখেছেন, ‘স্কুলে ১১ বছর বয়সে আমার বাচ্চাকে বিসিএস-এর প্রশ্ন দেবেন পরীক্ষায়। আমি কিছু বলতে পারবো না। সারাদিন-রাত পড়াশুনা করে প্রশ্নফাঁসের ফাঁসি নিয়ে ফেলু ছাত্রের জিপিএ পাওয়া দেখবো। আমার কিছু বলার থাকবে না। এসএসসির আগে আরও দুটো বোর্ড পরীক্ষা জেতাতে কোচিং এ লাখ টাকা ব্যয় করবো!! আমি বাধ্য কারণ, আমার সন্তানের ভালো আমার চেয়ে রাষ্ট্র নাকি বেশি চায়। চুপ থাকি… কিন্তু এই ভয়াবহ বিজ্ঞপ্তি দেখে আমি পাথর হয়ে গেছি!!!! এখন কি আমার শিশুকে রাজনীতিও করতে হবে?! আমার বাচ্চা। কষ্টের টাকায় নিজে না খেয়ে আমি পালি। এই শিশু লালন-পালনে কতটা ভাগ আপনার, যে আপনার কথামতো সে চলতে বাধ্য? আপনার কাছে খুচরা আলাপ, আমার আর আমার সন্তানের জীবন মরণ। মার চেয়ে মাসির দরদ বেশি হয়ে যাচ্ছে। মা হয়ে এই দরদ নেওয়া যাচ্ছে না। ’
অধ্যাপক মনজুরুল ইসলাম এ সম্পর্কে এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘আমাদের বড় দুই দল আদর্শহীন রাজনীতি করে। এই আদর্শহীনতা স্কুলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে যাওয়া মোটেও উচিত নয়।’ স্কুল পর্যায়ে কমিটি বন্ধ করতে তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে একে অন্যকে গালিগালাজ করা, দোষারোপ করা একটি সহজাত অভ্যাস। একজন শিক্ষার্থী কি এসব শিখবে ছোটবেলাতেই?’ তিনি বলেন, স্কুলে কমিটি করার অর্থ হলো এসব মূলধারার বা সরকারি দল সমর্থক সংগঠনের শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন ফাঁস করা শিখবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এইচ এম আলামিন আহমেদ এমন পদক্ষেপকে ধিক্কার জানিয়ে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, আমরা সকলেই অবহিত আছি যে বর্তমান ছাত্র রাজনীতি অতীতের ইতিহাস ঐতিহ্যকে ম্লান করে বর্তমানে কলুষিত হয়েছে (কলুষিত হয়েছে তা নয়; কলুষিত করা হয়েছে)। যদিও ছাত্র রাজনীতির ফলে দেশের জাতীয় ইস্যু গণতন্ত্র রক্ষা, সার্বভৌমত্ব রক্ষার ইস্যুতে ছাত্রনেতাদের ভূমিকা থাকলেও সামগ্রিকভাবে যদি ছাত্র রাজনীতির ফলাফল নির্ণয় করি তাহলে দেখা যাবে ছাত্ররাজনীতিকে অসুস্থ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়াতে এবং জাতীয় রাজনীতিতে দেশপ্রেমের অবক্ষয়ের কারণে আজকে মেধাবী হাজার হাজার ছাত্রনেতার ভবিষ্যৎ অন্ধকারের দিকে, এমনকি জীবনের ছন্দপতন হয়ে আজকে অনেকেই বিপথগামী হবার ইতিহাসও রয়েছে!
তিনি লিখেন, নিশ্চিত ধ্বংসের পথে যাবে, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দেশের সম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার সম্ভাবনাকে ধ্বংস করবে বলে আমি আশঙ্কা করছি। কেননা প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয় এগুলো হলো শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তি, সেখানে ছাত্ররাজনীতি প্রবেশ করিয়ে দিলে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতিভা বিকাশে বাধাগ্রস্ত হবে, শুধু তাই নয় বরং আমাদের জনসম্পদ বোঝা হয়ে দাঁড়াবে! এর সপক্ষে আমি শত শত যুক্তি উপস্থাপন করতে পারব। তার মধ্যে অন্যতম কিছু কারণ উল্লেখ করছি।
বাংলাদেশের আইনে আমার জানামতে ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু। আর একটা ছাত্র এসএসসি পাস করে ন্যুনতম ১৫ বছর বয়সে। তাহলে কোন যুক্তিতে শিশুদের ছাত্ররাজনীতিতে সম্পৃক্ত করা হবে? মাধ্যমিক পড়ুয়া একটা ছেলে নেতৃত্ব দিবে নাকি পড়াশোনা করবে? তাছাড়া ১০-১২ বছরের একটা ছাত্র কিভাবে নেতৃত্ব দেয়ার মতো সক্ষমতা অর্জন করবে? এটা কি বাচ্চার হাতে অস্ত্র তুলে দেয়ার সামিল নয়!
জনৈক হাসানুজ্জামান লিখেছেন, “রাজনীতি করে এরা দেশের কি উন্নতি টা করবে শুনি? সবগুলা তো শিখবে গুন্ডামী, ভন্ডামী আর জোচচুরি। এই দেশকে কখনো রাজনীতিবিদরা এগিয়ে নিতে পারবে না। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে দরকার বিজ্ঞান-প্রযুক্ত বিষয়ক শিক্ষা এবং তার প্রয়োগ। বর্তমান রাজনীতি হচ্ছে একটি ভন্ড পেশা কিংবা অবৈধভাবে টাকা উপার্জন এর একটি পন্থা। এভাবে চলতে থাকলে সমাজের ধ্বংস অনিবার্য।”
আসিফ লিখেছেন, “পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ তো গেছে এবার স্কুলগুলোও বাকি থাকবে না। কোমলমতি ছেলে মেয়েগুলো আগেই হাতে কলমে শিক্ষা নিবে কি করে টেন্ডারবাজি করতে হয়।”
ফেরদৌস লিখেছেন, “এ ব্যাপারে আওয়ামীপন্থী ৃৃও শিক্ষাবিদদের বক্তব্য শুনতে চাই!”
মোরশেদ লিখেছেন, “স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা ভোটার না, ১৮ বৎসরের আগে ভোটার হতে পারে না। আর মাধ্যমিক স্কুলের ছাত্র ছাত্রীদের বয়স ১৪ বা ১৫ এর বেশি হয়না। স্কুল এর এই ছোট শিশুদেরকেও নষ্ট করে দিচ্ছে আওয়ামীলীগ এর নোংরা রাজনীতি।
অন্য একজন লিখেছেন, “দেশ এবং দেশের শিক্ষাঙ্গণ ধ্বংসের একটি পদক্ষেপ!”
আরেকজনের মন্তব্য, “প্রশ্নপত্র ফাঁস, শিক্ষকের অপ্রতুলতা, গাইড বই, কোচিং বাণিজ্য, পাঠ্য পুস্তকে ভুল, এমপিও ভুক্ত করণে জটিলতা ইত্যাদি নানা সমস্যায় যখন আমাদের মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থা যখন ডুবতে বসেছে সে সময় ছাত্রলীগের এ সিদ্ধান্ত মাধ্যমিক শিক্ষার কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়ারই নামান্তর।” ফ্রান্স প্রবাসী আবদুর রব এ বিষয়টিতে চরম উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে তাদের কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছে তাদের সাংগঠনিক ইউনিটকে। আমি একজন সন্তানের পিতা ও দেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে এই চরম হঠকারি ও আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
তার মতে, সব কিছুরই একটা বয়স সীমা আছে। নির্ধারিত বয়সের আগে কিছু হলে তাকে অকাল পক্ক বলে। বিদ্যার্জনের সর্বোত্তম সময়ে রাজনীতি শেখানোর কোনো প্রয়োজন নাই। সুশিক্ষায় শিক্ষিত হলে উপযুক্ত বয়সে প্রাকৃতিক ভাবেই রাজনীতি শিখবে। দেশে অচিরেই এই আইন করা উচিৎ যেভাবে আঠার বছর বয়স না হলে কেউ ভোটার হতে পারে না ঠিক সেভাবেই আঠার বছর না হলে কেউ রাজনীতিও করতে পারবে না। আঠার বছর বয়স না হলে কোনো মানুষ মানসিক ভাবে পরিপূর্ণতা লাভ করে না। তাহলে কীভাবে সে রাজনীতির জন্যে উপযুক্ত বিবেচিত হয়? আঠার বছর বয়স পর্যন্ত পুরোটা সময় যেন একজন শিক্ষার্থী তার পড়াশুনার পেছনে ব্যয় করে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এমনিতেই সহস্র সমস্যায় জর্জরিত তদুপরি মরার উপর এই খাঁড়ার ঘা কেন? মনে হচ্ছে অতি সুপরিকল্পিতভাবে আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিচ্ছি।
কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তো প্রতিনিয়ত ছাত্র নেতাদের হাতে লাঞ্ছিত অপমানিত হচ্ছেন। কলেজ ভার্সিটির অধ্যক্ষকে অফিসে তালাবদ্ধ করে রাখার পর পুলিশ এসে উদ্ধার করছে এমন সংবাদ তো প্রায়ই আমাদের শুনতে হয়। এ সকল দৃশ্য কি আমরা এখন স্কুলগুলোতেও দেখতে চাচ্ছি? স্কুল পর্যায়ে রাজনৈতিক কমিটি গঠন আর কোমলমতি ছাত্রদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়ার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই বলেই মনে করি। পারলে তাদেরকে নৈতিক শিক্ষা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে উৎসাহিত করা হোক। তাদেরকে সকল প্রকার রাজনীতির বাইরে রাখা হোক। কোনো রাজনৈতিক নেতার আগমন উপলক্ষে তাদেরকে ফুলের তোড়া হাতে দাঁড় করিয়ে রাখার নির্লজ্জ তোষামোদী সংস্কৃতি বন্ধ করা হোক। বর্তমানে ছাত্র রাজনীতি এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। তাই আমাদের কোমলমতি ছাত্রদের এই নোংরা রাজনীতিতে জড়ানোটা হবে চরম এক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। কিছুদিন আগে শুনেছিলাম শিশুলীগ নামে একটি সংগঠনের কথা। ভেবেছি- হাসি ঠাট্টা। অনলাইনে তো কত কিছু নিয়েই হাসি তামাশা হয়। এখন তো অতি আতংকগ্রস্ত হয়ে দেখছি ঘটনা ভয়াবহ। এরপর এই নোংরা রাজনীতির জীবাণু তো আস্তে আস্তে প্রাইমারি পর্যন্ত চলে আসবে। এটা কি কোনো রাজনৈতিক টিকাদান কর্মসূচি যে বাদ যাবেনা কোনো শিশু অভিযান শুরু করেছেন?
ছাত্রলীগ বলছে শুধু তারাই নয়- ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়নসহ আরো অনেক রাজনৈতিক দলের কমিটি মাধ্যমিক স্কুল গুলোতে রয়েছে। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কমিটি রয়েছে বলে তোমাদেরকেও কমিটি গঠন করতে হবে এমন তো কোনো কথা নয়। তোমাদের কাছে জাতির প্রত্যাশা বেশি। তোমরা বরং এর প্রতিবাদ করবে, রাস্তায় নামবে। যাতে কোনো রাজনৈতিক দল এরূপ কমিটি গঠন করে ছাত্র ছাত্রীদের ভবিষ্যত নষ্ট করতে না পারে, জাতির অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে তা প্রতিরোধ করবে। তা না করে তোমরাও সেই একই ধারায় শিশুদের ব্যবহার করতে চাচ্ছ যা সত্যিই হতাশাজনক। অনেক ছাত্র সংগঠনের গঠনতন্ত্রেই নাকি স্কুল কমিটির কথা উল্লেখ আছে। এরূপ থাকলে অনতিবিলম্বে তাদের গঠনতন্ত্রে পরিবর্তন আনা দরকার। অন্তত জাতির ভবিষ্যত এ সকল শিশুদের অংকুরে বিনষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা করতে এর বিকল্প নেই।
স্কুলের শিক্ষার্থীদের কাজ লেখাপড়া, খেলাধূলা, সংস্কৃতি চর্চা ইত্যাদি। এখানে তাদের রাজনীতি শেখানোর কি দরকার? এতে কাদের স্বার্থ নিহিত? মাধ্যমিক লেভেলের পড়ালেখা কমপ্লিট করেও তাদের সামনে রাজনীতি শেখার যথেষ্ট পরিমাণ সময় পড়ে আছে। আমরা কেবলমাত্র মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে ছাত্র রাজনীতির বিপক্ষে তা নয়। বরং সকল পর্যায়ের ছাত্র রাজনীতি বন্ধের পক্ষেই আমাদের অবস্থান। এর কারণ সবাই জানেন। আজকাল ছাত্র রাজনীতিতে আদর্শ বা নৈতিকতা বলতে কিছ্ইু অবশিষ্ট নেই। লেজুড়বৃত্তি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-কোন্দল, হানাহানিসহ সকল ধরনের অপকর্মে ছাত্রনেতারা জড়িত। তারপরও যদি একান্তই ছাত্র রাজনীতি করতে হয়, যদি এখনো ছাত্র রাজনীতির ধ্যে সামান্য কোনো ভাল দিক আপনারা দেখতে পান তাহলে অন্তত মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত আমাদের শিশুদের রেহাই দিন। ছাত্র রাজনীতির বিষাক্ত ছোবলে আমাদের সন্তানদের নীলকন্ঠ লাশ আমরা দেখতে চাইনা। এখানে যে আপনাদের বিশাল রাজনৈতিক স্বার্থ জড়িত আছে তা বুঝতে আমাদের মোটেই কষ্ট হচ্ছেনা।
ছাত্রলীগের দাবি তারা বঙ্গবন্ধুর মহান আদর্শ ও মুক্তি যুদ্ধের চেতনা, মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার মহৎ উদ্দেশ্য সামনে নিয়ে স্কুল কমিটি গুলো গঠন করছেন। খুব ভালো। আমরা মোটেই এর বিরোধিতা করছিনা এবং এর গুরুত্বও আমাদের অজানা নয়। আমাদের অনীহা শুধু ছাত্রছাত্রীদের অপরিপক্ষ বয়স নিয়ে। অন্তত এ বয়সে যেন তাদের উপর এসব অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দেওয়া না হয়। ছাত্র রাজনীতির কর্মকাণ্ড যদি এ দুটি বিষয়েই সীমাবদ্ধ থাকতো তবুও নাহয় কিছু সময়ের জন্য মেনে নেওয়া যেত। কিন্তু সেরূপ কল্পনা করা বাতুলতা মাত্র। শিক্ষার্থীরা এ বিষয়গুলো তো পাঠ্যপুস্তক থেকেই শিখতে পারবে। আমাদের শিক্ষকবৃন্দ থাকতে আপনারা ছাত্র নেতারা শিক্ষাদানের এ দায়িত্ব কেন নিচ্ছেন তা বোধগম্য নয়। আর বঙ্গবন্ধু এমন কেউ না যে, মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের সাথে জোর করে তাকে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। বরং বঙ্গবন্ধু হচ্ছেন বাংলার আকাশে এক বিশাল সূর্য। বাংলার আলো বাতাসে কেউ বেড়ে উঠবে আর তার গায়ে এই সূর্যের আলো লাগবেনা তা কি করে সম্ভব?
কেউ বাংলাদেশের ইতিহাস লিখবে কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কথা লিখবেনা এটা যেমন অসম্ভব তেমনি কেউ বঙ্গবন্ধুর কথা লিখবে কিন্তু বাংলাদেশের কথা লিখবেনা তাও অসম্ভব। বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশই বঙ্গবন্ধু। এই সত্য অস্বীকার করার ধৃষ্টতা বাংলাদেশে কেউ দেখাবেনা। তাই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অহেতুক হৈচৈ এবং অতিরঞ্জিত কর্মকাণ্ড তাকে অসম্মানের নামান্তর। তখন এটা পরিষ্কার হয়ে উঠে যে এই অপ্রয়োজনীয় ও নির্লজ্জ লম্ফঝম্পের পেছনে হীন স্বার্থ ছাড়া আর কিছুই নেই।
আপনারা যদি শিক্ষার্থীদের বঙ্গবন্ধুর আদর্শ শিক্ষা দিতে যান তাহলে একেক দল একেক ভাবে বঙ্গবন্ধুকে উপস্থাপন করে এক বিকৃত ইতিহাস তাদের শেখাবেন এতে শিক্ষার্থীরা ছোটবেলা থেকেই বিভ্রান্তি নিয়ে বড় হবে। এর চেয়ে বরং আমাদের শিক্ষকদেরকে এ দায়িত্ব পালনের সুযোগ দেন এবং শিক্ষার্থীদেরকেও সুযোগ দেন যাতে তারা নিজেরাই এসব ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারে অনুসন্ধান ও গবেষণা করতে পারে। আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আপনারা যেভাবে একেক দল একেক ভাবে কেজি দরে বিক্রি করছেন, তা বলতেও রুচিতে বাধে। এতে ছাত্র-ছাত্রীদের বস্তুনিষ্ঠ ও সত্য ইতিহাস জানা তো দূরের কথা তারা বিভ্রান্তির এক অথৈ সাগরে হাবুডুবু খাবে।
আমাদের দেশের বড় দুইটি রাজনৈতিক দলই আদর্শহীন রাজনীতি করছে। আওয়ামী লীগ যেমন বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে যোজন যোজন দূরে তেমনি বিএনপিও জিয়ার আদর্শ থেকে বিচ্যুত। এই আদর্শহীনতা কি আমরা মাধ্যমিক পর্যায়ের শিশুদের কাছে সগর্বে পৌঁছে দেব? বর্তমানে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি হচ্ছে, একে অন্যকে গালি গালাজ করা, দোষারোপ করা, মারামারি করা, হানাহানি করা। কোমলমতি শিশুদের মাঝে আমরা কি এ ভাইরাস ঢুকিয়ে দেব? স্বভাবতই সরকারি দলের ছাত্ররা অন্যান্য দলের ছাত্রদের সাথে দাপট দেখায়, প্রভাব খাটাতে চায়। তখন মারামারি হানাহানি অনিবার্য হয়ে পড়ে। তখন শিক্ষকদেরকে পড়ালেখা করানো বাদ দিয়ে ছাত্রদের বিচার-আচারে ব্যস্ত থাকতে হবে। প্রতিষ্ঠানগুলোয় কি ভয়ানক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি হবে তা কি একবার ভেবে দেখবেন সুপ্রিয় ছাত্র নেতারা?
প্লিজ আমাদের দয়া করুন। আমাদের সন্তানদের বাঁচান। আমাদের প্রতিষ্ঠান গুলোকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচান। আমাদের দেশের ভবিষ্যত প্রজন্মকে বাঁচান।
শীর্ষনিউজ২৪ডটকম

Facebooktwitterredditpinterestlinkedinby feather
Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।