দুই মন্ত্রণালয়ের সম্মতিতে নতুন এমপিওভুক্তির কার্যক্রম শুরু

বিভাষ বাড়ৈ:

অর্থ এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সম্মতি অনুসারে নতুন এমপিওভুক্তির কার্যক্রম শুরু হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রীর পক্ষ থেকে সরকারের ইতিবাচক সিদ্ধান্তের কথাও জানানো হয়েছে। এমপিওবিহীন প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তিতে বার্ষিক দুই হাজার ১৮৪ কোটি টাকা প্রয়োজন। সব দিক মাথায় রেখেই কাজ শুরু হয়েছে। তবু অনশন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় নন-এমপিও বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে পঞ্চম দিনের মতো অনশন করেছেন তারা। এ নিয়ে ১১ দিন ধরে সেখানে অবস্থান নিয়ে আছেন শিক্ষকরা। আন্দোলনকারীদের দাবি এমপিওভুক্তির সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ ছাড়া তারা যাবেন না। তারা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপও চান।

প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির দাবিতে ‘নন-এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী ফেডারেশনে’র ব্যানারে গত ২৬ ডিসেম্বর থেকে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচী পালন করে আসা দেশের বিভিন্ন এলাকার কয়েকশ’ শিক্ষক গত রবিবার সকাল থেকে আমরণ অনশন শুরু করেন। তাদের অনশন ভাঙ্গাতে মঙ্গলবার সকাল এগারোটায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অনশনস্থলে যান শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। এ সময় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সোহরাব হোসাইন, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব মোঃ আলমগীর ছাড়াও অর্থমন্ত্রীর একজন প্রতিনিধি, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর ও ডিআইএর উর্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সেখানে যাওয়ার আগে সকালেই শিক্ষামন্ত্রী বৈঠক করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে। অর্থমন্ত্রীর বাসভবনে বৈঠকে নীতিমালা অনুসারে নতুন প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির সম্মতি দেন অর্থমন্ত্রী। এরপর আন্দোলনকারীদের কাছে সরকারের ইতিবাচক অবস্থানের কথা জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, অনেক চেষ্টার পর তিনি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছ থেকে সম্মতি আদায় করতে পেরেছেন।

মন্ত্রী বলেন, আমি কথা দিচ্ছি এমপিওভুক্তির দাবি পূরণ করে দেব। টাকা, পয়সা, অর্থের ব্যাপার আছে। অর্থমন্ত্রী রাজি হয়েছেন, আমরা কাজ এগিয়ে রেখেছি। গত কয়েক মাস ধরে আমি অর্থমন্ত্রীকে কনভিন্স করার চেষ্টা করছি, বলেছি নীতিমালা করে দেন ওটা মেনেই কাজ করব। রোজ চাপ দিচ্ছি, রোজ দেখা করছি। নীতিমালা করে দিয়ে বলেছি এটা দিলাম, আপনারা দেখেন। আপনারা কষ্টে আছেন, আমিও কষ্ট পাচ্ছি। আমি অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি সম্মতি দিয়েছেন, এমপিওভুক্ত যারা হননি তাদের এমপিওর ব্যবস্থা করা হবে। এটা আমাদের বিজয়, প্রথম স্বীকৃতি। নীতিমালা বাস্তবায়নের ব্যবস্থা নেব।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাউশি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অর্থ এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সম্মতি অনুসারে ইতোমধ্যেই নতুন এমপিওভুক্তির কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে সংশোধিত এমপিও নীতিমালার খসড়া অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে চূড়ান্ত হয়ে আসার পর শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিওভুক্তির জন্য আবেদন চাওয়া হবে। এরপর যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে এমপিওভুক্ত করা হবে। এমপিওভুক্তির দাবিতে শিক্ষক-কর্মচারীদের টানা আন্দোলন শুরু হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এই কার্যক্রম শুরু করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এমপিওপ্রত্যাশীদের যাচাই-বাছাই করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে শিক্ষা অধিদফতরকে (মাউশি)।

কর্মকর্তারা বলেছেন, এ মুহূর্তে থোক বরাদ্দ পেলে দুই থেকে আড়াই হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হতে পারে। ছয় মাস পর ২০১৮-১৯ সালের বাজেটে আরও আড়াই হাজার নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করার পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। জানা গেছে, সংশোধিত নীতিমালা অনুযায়ী ভাল ফল, প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো, পর্যাপ্ত শিক্ষার্থী, শিক্ষকের শিক্ষাগত যোগ্যতাসহ কয়েকটি বিষয় মূল্যায়ন করে শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির জন্য নির্বাচন করা হবে।

২০০৯ সালের ১৬ জুন সর্বশেষ নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির পর আর কোন প্রতিষ্ঠান এমপিও হয়নি। বর্তমানে সারাদেশের প্রায় সাড়ে সাত হাজার নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির বাইরে আছে।

এমপিওসংক্রান্ত মাউশির করা প্রস্তাবে মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে, সারাদেশের এমপিওবিহীন সাত হাজার ১৪২ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করতে বার্ষিক দুই হাজার ১৮৪ কোটি ২৭ লাখ ৫২ হাজার ২৫০ টাকা লাগবে। এর মধ্যে এক হাজার ২২৭ নিম্ন-মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের জন্য ২১৯ কোটি ৭১ হাজার ৩০০ টাকা, এক হাজার ৮৯ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের জন্য ৩৬৮ কোটি ১৫ লাখ ২৭ হাজার ৮৫০ টাকা, এমপিওভুক্ত তিন হাজার ২৭৫ নিম্ন-মাধ্যমিক বিদ্যালয়কে মাধ্যমিকে উন্নীত করে এমপিওভুক্ত করতে ৫২২ কোটি ৬০ লাখ ৮১ হাজার ২৫০ টাকা।

৫১৮ উচ্চ মাধ্যমিক কলেজের জন্য ৩৫৭ কোটি ১২ লাখ ৪৭ হাজার ৪০০ টাকা এবং এমপিওভুক্ত এক হাজার ৩৩ উচ্চ মাধ্যমিক কলেজকে ডিগ্রী স্তরে উন্নীত করে এমপিওভুক্ত করতে ৭১৭ কোটি ৩৮ লাখ ২৩ হাজার ৪৫০ টাকা লাগবে। ডিগ্রী কলেজ এমপিওভুক্ত করতে বছরে লাগবে ৬৯ লাখ ৪৪ হাজার ৬৫০ টাকা, উচ্চ মাধ্যমিক কলেজের জন্য লাগবে ৬৮ লাখ ৯৪ হাজার ৩০০ টাকা, আর নিম্ন-মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের জন্য লাগবে ১৫ লাখ ৯৫ হাজার ৭৫০ টাকা।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের অতিরিক্ত সচিব জাবেদ আহমেদ জানিয়েছেন, নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের এমপিওভুক্তকরণে আমরা প্রাথমিক প্রক্রিয়া শুরু করেছি। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ ছাড়ের আশ্বাসে এ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, এমপিওভুক্তির নীতিমালা সংশোধন করে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে চূড়ান্ত হয়ে আসলে আমাদের পরবর্তী কার্যক্রম শুরু হবে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের যুগ্ম সচিব সালমা জাহান বলেন, নতুন এমপিওভুক্তি সংক্রান্ত মাউশি থেকে একটি প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এই মুহূর্তে সারাদেশে এমপিওভুক্তির সব শর্ত পূরণ করে অপেক্ষমাণ পাঁচ হাজার ২৪২ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এগুলোতে কর্মরত এমপিওভুক্তির যোগ্য শিক্ষক-কর্মচারী আছেন প্রায় ৭৫ হাজার। তাদের সবাইকে এক অর্থবছরের বাজেটে এমপিওভুক্ত করা কঠিন। এজন্য পর্যায়ক্রমে যোগ্য সবাইকে এমপিওভুক্ত করা হবে। তিনি বলেন, এ মুহূর্তে থোক বরাদ্দ পেলে দুই থেকে আড়াই হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হতে পারে। ছয় মাস পর ২০১৮-১৯ সালের বাজেটে আরও আড়াই হাজার নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করার পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে।

কর্মকর্তারা বলছেন, অর্থমন্ত্রীর কাছে জমা দেয়া সংশোধিত নীতিমালার খসড়ায় জনসংখ্যা অনুপাতে সংশ্লিষ্ট এলাকায় এমপিওর প্রাপ্যতা নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে। এর সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য কয়েকটি শর্তজুড়ে দেয়া হয়েছে। এমপিওভুক্ত হতে চাইলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিজস্ব জমি থাকতে হবে। ভাড়া ভবনে শিক্ষা কার্যক্রম চালানো প্রতিষ্ঠান যোগ্য বলে বিবেচিত হবে না। তবে নীতিমালা অনুসারে প্রাপ্য না হলেও দেশের পিছিয়ে পড়া এলাকা, চা-বাগান, হাওড়, পার্বত্য এলাকাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে। প্রত্যেক উপজেলায় কমপক্ষে একটি প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করা হবে।

মাউশির পরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক শামছুল হুদা বলছিলেন, ২০১০ সালের পরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনুমোদন দেয়ার সময় এমপিওভুক্ত না করার অঙ্গীকারনামা নেয়া হয়। সে অনুযায়ী কোন প্রতিষ্ঠান সরকারী কোন এমপিও বা অনুদান পাওয়ার কথা নয়। নিজেদের ব্যয়ে এসব প্রতিষ্ঠান চালানোর কথা ছিল। বর্তমান সরকার অনেক সহনীয়। এ কারণে আন্দোলনকারী শিক্ষকদের দুর্দশার বিষয়টি বিবেচনা করে তাদের এমপিওভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

তবে সরকারের এসব পদক্ষেপেও আন্দোলন তুলতে রাজি নন শিক্ষকরা। তারা এখনই এমপিও বাস্তবায়ন চান। বৃহস্পতিবার কর্মসূচী থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছে দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। আগেও ওয়াদা দেয়া হয়েছে। এইবার আর ওয়াদা নয়। শিক্ষকরা বাস্তবায়ন চান।

অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়লেও কর্মসূচী চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে এখনও অটল শিক্ষকরা। তারা বলছেন, এবার সুনির্দিষ্ট ঘোষণা অথবা প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস না পেলে তারা বাড়ি ফিরে যাবেন না। শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন মহাজোটের শরিক দলের একাধিক নেতাও। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অনশনে থাকা নন-এমপিও শিক্ষকদের আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছেন তারা।

মহাজোটের শরিক সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া শিক্ষকদের মাঝে উপস্থিত হয়ে বলেন, শিক্ষকদের দাবি উপেক্ষা করে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া সম্ভব নয়। তিনি বলেন, বেসিক ব্যাংক, শিল্প ব্যাংকের অর্থ লুটপাট হয়েছে। এত টাকা চুরি হয় আর শিক্ষকদের এমপিওভুক্তি বাবদ এক হাজার কোটি টাকা কেন ভর্তুকি দেবে না সরকার? তিনি বলেন, শিক্ষকরা জাতি গঠনে কাজ করে যান। তাদের কথা অবশ্যই প্রধানমন্ত্রী বিবেচনা করবেন।

দুপুর সাড়ে বারোটার দিকে ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, শিক্ষকদের দাবি যৌক্তিক। শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য শিক্ষক বা সমাজের জন্য শোভনীয় নয়। শিক্ষামন্ত্রীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাই শিক্ষকদের দাবি পুনরায় বিবেচনা করুন। সূত্র:জনকন্ঠ

Facebooktwitterredditpinterestlinkedinby feather
Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।