কলেজ বন্ধ কিন্তু কাগজ-কলমে এখনও শিক্ষা কার্যক্রম সচল

38444_151কথা ছিল ৬ মাসের মধ্যে এমপিওভুক্ত হবে। সরকারি বরাদ্দ হয়েছিল দ্বিতল একাডেমি ভবন। ২৬ জন শিক্ষক-কর্মচারী আর আড়াইশ’ শিক্ষার্থী ছিল উচ্ছ্বাসিত কিন্তু বিগত ১৬ বছরেও সে প্রতিক্ষার অবসান হয়নি। সরকারি স্বীকৃতি পেয়েও কেবল আর্থিক অনটনের কারণে ১৬ বছর যাবৎ শিক্ষা প্রদানে অনুপযোগী হয়ে রয়েছে একটি সাজানো-গোছানো কলেজ।

গত ১০ বছর কলেজের তালা খোলা না হলেও কাগজ-কলমে সচল রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতি বছর কলেজের নামে পরীক্ষা দিচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষক রয়েছেন ২৪ জন। কিন্তু কোথায় সেটা কেউ জানেন না। কলেজের টিনশেড বিল্ডিং যা দুই বছর আগে ঝড়ে ভেঙে গিয়ে পুরোপুরি পরিত্যক্ত। মূল ভবনের তালাও খোলা হয়নি অনেক বছর। মাঠে চষে বেড়ায় গরু-ছাগল। আর চারপাশ জুড়েই আগাছার জঙ্গল।

পরিচালনা পর্ষদের অনিয়মের কারণেই এই দুরবস্থা বলে জানা গেছে। সরজমিন ঘুরে দেখা গেছে, উপজেলার কাঞ্চন পৌরসভার তারাইল এলাকার ব্যবসায়ী মরহুম আব্দুল আজিজ তার এবং তার স্ত্রী আয়েশা খাতুনের নামে ১৯৯২ আব্দুল আজিজ-আয়েশা খাতুন কলেজ নির্মাণ করেন। কলেজটি সুনামের সঙ্গে ৪ বছর একাদশ শ্রেণি পর্যন্ত তাদের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার পর আর্থিক টানাপড়েনের কারণে ১৯৯৬ সালে সেটা বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীকালে সরকারের ফ্যাসিলিটিজ ডিপার্টমেন্ট নতুন ভবন নির্মাণের জন্য ৩৯ লাখ টাকা আর্থিক অনুদান প্রদান করলে ১৯৯৮ সালে নতুন দ্বিতল ভবনের নির্মাণকাজ শুরু করেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান শামীম এন্টারপ্রাইজ।

২০০০ সালে রূপগঞ্জের তৎকালীন সংসদ সদস্য মেজর জেনারেল (অব.) কেএম শফিউল্লাহ (বীর উত্তম) সে ভবনের উদ্বোধন করেন। এরপর নতুন উদ্যোমে শুরু হয় শিক্ষা কার্যক্রম। সে সময় এমপি মহোদয় ৬ মাসের মধ্যে কলেজটি এমপিও ভুক্ত করে দেয়ার আশ্বাস দেন। ভবন উদ্বোধনের কিছুদিন পর এমপিওভুক্ত করার জন্য যথাযথ নিয়ম মেনে শিক্ষা অধিদপ্তর বরাবর কাগজপত্র চেয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে একটি চিঠিও আসে কলেজে। যে পরিমাণ শিক্ষার্থী ও শিক্ষক নিয়োগসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক শর্ত পূরণ করতে হয় তা না করেই শিক্ষা অধিদপ্তর বরাবর কাগজপত্র প্রেরণ করে আব্দুল আজিজ-আয়েশা খাতুন কলেজ কর্তৃপক্ষ। যে কারণে তখন তাদের এমপিওভুক্ত আটকে যায়। এরপর সরকারের ক্ষমতাবদল হলে কলেজটি সরকারিকরণের আশা পুরোপুরি চলে যায়। এরই মাঝে ২০০২ সালে মারা যান কলেজের প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল আজিজ মিয়া।

এরপর শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনভাতা প্রদানে অনিশ্চয়তা দেখা দিলে আস্তে আস্তে অনুপস্থিত হতে থাকেন শিক্ষকরা। কমে আসে শিক্ষার্থীর সংখ্যাও। ২০০৩ সালের দিকে কলেজটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। এরপরও বিভিন্ন অনুমোদনবিহীন কলেজের শিক্ষার্থীরা এই কলেজের নামে পরীক্ষা দিতে থাকে। ৩ বছরের বেতনভাতা বকেয়া থাকায় স্বপদ থেকে ২০১০ সালে কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ শাখেরুজ্জামান সরে দাঁড়ান। এরপর পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ও আব্দুল আজিজ মিয়ার ছোট ছেলে ইব্রাহিম মিয়া সৈয়দ শাহ জামান নামে অপর আরেকজনকে অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দিলেও তাকে আজ পর্যন্ত তারাইল এলাকার কেউ দেখেনি। এমন কি তিনি কোথায় থাকেন, বাড়ি কোথায় কেউ জানেন না।

কাগজ-কলমে এখনও শিক্ষা কার্যক্রম সচল থাকলেও এই কলেজের শিক্ষক কারা বা শিক্ষার্থী কারা এবং তারা কখন কোথায় ক্লাস করেন তা কেউ জানে না। অথচ চলতি বছর আব্দুল আজিজ-আয়েশা খাতুন কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় ৬৩ জন অংশগ্রহণ করে ৬০ জন কৃতকার্য হয়েছে। গত বছর উপবৃত্তি পেয়েছেন কলেজের ১৩ শিক্ষার্থী। কিন্তু সেই শিক্ষার্থী কারা সে রহস্য আজও অজানা।

কলেজ লাগোয়া বাড়ির বাসিন্দা আব্দুস সামাদ জানান, দুই বছর আগে ঝড়ে কলেজের একতলা টিনশেড ভবনটি পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে সেটি বর্তমানে পরিত্যক্ত। তারাইল উত্তরপাড়া এলাকার মজিবর রহমান বলেন, শুনেছি প্রতি বছর অনেক ছেলেপেলে কলেজ থেকে পাশ করে কিন্তু তারা কোথায় পড়ে কোথায় ক্লাস করে সেটা জানি না।

অনেক বছর যাবৎ কলেজের তালা খুলতে দেখিনি কাউকে। কলেজ মাঠে গরু-ছাগল চষে বেড়ায়। চারপাশ জুড়েই আগাছার জঙ্গল। রাতের বেলায় পুরোপুরি ভুতুড়ে পরিবেশ। এছাড়া সবদিকে জুড়েই সাপ-গোপের নিরাপদ আস্তানা। এ ব্যাপারে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার সিদ্দিকী নূরে আলম বলেন, ২০১৬ ও ২০১৭ শিক্ষা বর্ষে এ কলেজে কোনো শিক্ষার্থী রয়েছে কিনা সে বিষয়ে জানতে চেয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছিলাম। তাদের কাছ থেকে কোনো উত্তর পাইনি। সেজন্য আমরা শিক্ষা বোর্ডে এবার এ কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে বলে চিঠি দিয়ে দিয়েছি।

আগে কীভাবে পরীক্ষায় অংশ নিতো সেটা আমার জানা নেই। বর্তমানে কলেজের কার্যক্রম একেবারেই বন্ধ রয়েছে বলে তিনি আরো জানান। অত্র কলেজের সাবেক করনিক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, কোনো টাকা পয়সার বিনিময়ে নয় কলেজের নাম সচল রাখতে কেবল সরকারি নিবন্ধনের টাকা দিয়ে বাইরের ছেলেমেয়েরা আব্দুল আজিজ-আয়েশা খাতুন কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দেয়। আমরা এই সুযোগ দেই কেবল আমাদের কলেজের নামটা টিকিয়ে রাখতে। কলেজটি একদিন এমপিওভুক্ত হবে এই আশায় এখনো আমরা এখনো হাল ধরে আছি।

এ ব্যাপারে কলেজের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ও আব্দুল আজিজ মিয়ার ছোট ছেলে ইব্রাহিম মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য চেষ্টা করা হলে তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি বন্ধ পাওয়া গেছে। তিনি তাবলীগ জামায়াতে এলাকার বাইরে রয়েছেন বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। কলেজটি পুনরায় সচল হলে উপজেলার দাউদপুরের উত্তরাঞ্চল, ভোলাব ইউনিয়ন এবং কাঞ্চন পৌরসভার ৩-৪টি ওয়ার্ডের শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষার আরো অধিক সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে স্থানীয়রা জানান।

সুত্র: মানবজমিন

Facebooktwitterredditpinterestlinkedinby feather
Image Not Found

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।